পড়াশোনার খবর নাই, পরীক্ষা কিন্তু নেওয়া চাই

দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিতভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে গত ১২ সেপ্টেম্বর। স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বেশির ভাগ শ্রেণির শিক্ষার্থীর সপ্তাহে এক দিন স্কুলে হাজির হওয়ার কথা। কোনো কোনো স্কুলে শ্রেণি-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একাধিক দলে ভাগ করে ক্লাসে আনা হচ্ছে। এক মাস চলার পর দুর্গাপূজার ছুটিতে যায় শিক্ষার্থীরা।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এক মাসের সব অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে আগামী দিনগুলোর জন্য নতুন নির্দেশনা দেওয়া হবে। ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাসংক্রান্ত দুটি নির্দেশনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। যদিও ইতিমধ্যে পিইসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে একশ্রেণির কোচিং সেন্টার ও গৃহশিক্ষকেরা গ্রাম-গঞ্জে তৎপর হয়েছেন। কাজেই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিখন কার্যক্রমে নেওয়ার জন্য পিইসি না হওয়ার ঘোষণাটি যেন সর্বত্র ঠিকমতো পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার।

সপ্তাহে এক দিন স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি গ্রাম-গঞ্জে শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটির কোনো সমীক্ষা আমার চোখে পড়েনি। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত ভোলা, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের পাঁচটি স্কুলে যান। স্কুলগুলোতে গিয়ে তাঁরা একটি বিষয় আবিষ্কার করেন, যা হয়তো তেমন কেউ ভাবেননি। গবেষণায় উঠে আসে, বেশ কয়েকটি স্কুলে শিক্ষার্থী আসছে কম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নিচের ক্লাসের এক শিক্ষার্থী একই পাড়া বা মহল্লার উঁচু শ্রেণির একজন বা একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যাতায়াত করে। কিন্তু সপ্তাহে এক দিনের কারণে একই দিনে তাদের ক্লাস না থাকায় ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আর স্কুলে আসতে পারছে না। তার অভিভাবকদের পক্ষে পৃথকভাবে তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করাও সম্ভব হচ্ছে না। আমার মনে পড়েছে, মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার সময় আমরা দল বেঁধে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাতায়াত করতাম। পাড়ার বড় ভাইদের সঙ্গে যেতাম বলে আমাদের অভিভাবকেরাও নির্ভার থাকতেন।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনাকাল আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গ্রাম ও শহরের বস্তি এলাকায় করা বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৭৯ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখায় ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাদের মধ্যে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর, পৃ.-৩)। সেখানে বলা হয়েছে, ‘গ্রামের ৪৪ শতাংশ পরিবারের এবং শহরের ৩৬ শতাংশ বস্তিবাসী শিক্ষার্থীর অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই।’ ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য। জরিপের ১৫ শতাংশের বেশি পরিবার জানায়, মহামারির শুরু থেকে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে ভুগছে। অভিভাবকেরা জানান, স্কুল বন্ধ থাকাকালে সন্তানদের আচরণ তুলনামূলক বেশি অসহনশীল, খিটমিটে ও রাগান্বিত ছিল।

২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত জাতি হওয়ার জন্য আমাদের যে প্রত্যাশা, তার জন্য সমস্যা সমাধানে পটু প্রজন্ম তৈরিতে আমাদের কোনো ছাড় দেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। আর জানুয়ারি-ডিসেম্বর শিক্ষাবর্ষ এমন কোনো অতি আবশ্যক বিষয়ও নয় যে সেটি আপাত পরিবর্তন করা যাবে না

এ ছাড়া ১৯ অক্টোবর ইউনিসেফ ও ইউনেসকো প্রকাশিত এশিয়ায় শিক্ষা খাতের ওপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে স্কুল বন্ধ ছিল। এ কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে (কোভিডে শিক্ষার ক্ষতি: বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে, প্রথম আলো অনলাইন, ২০ অক্টোবর ২০২১)।

এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমিয়ে কীভাবে তাদের পরবর্তী শ্রেণির পাঠোপযোগী করা যায়, সেটিই হওয়া উচিত এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনে রাখতে হবে, সপ্তম শ্রেণির বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ষষ্ঠ শ্রেণিতে যেমন কোনো পড়ালেখার সুযোগ পায়নি, তেমনি সপ্তম শ্রেণিতেও এ পর্যন্ত তার ক্লাস হয়েছে মাত্র চারটি! একই কথা প্রযোজ্য দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে। গত ১৯ মাসে তারও স্কুলে উপস্থিতি মাত্র চার দিন।

ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করেছে! বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাক্‌-নির্বাচনী পরীক্ষা নিতে হবে। বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ গণিত বিষয়ের পরীক্ষা নিতে হবে। এতে মনে হচ্ছে, পড়াশোনা হোক বা না হোক, পরীক্ষাটা যেকোনোভাবে নেওয়াই হচ্ছে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য!

জানা কথা, বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আর স্কুলমুখো করা যাবে না। ফলে ডিসেম্বর মাসও শিক্ষার্থীরা স্কুলের বাইরেই থেকে যাবে। তা ছাড়া বাংলা, ইংরেজি ও গণিত ছাড়াও যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলো পড়ানোর ব্যাপারে স্কুলগুলোতে তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না।

শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি মোকাবিলার জন্য এখন সপ্তাহের সব কটি দিনের জন্য স্কুলগুলো খুলে দেওয়া দরকার। আড়াই মাসে দুটি শিক্ষাবর্ষের মূল বিষয়গুলো আয়ত্ত করে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের জন্য তৈরি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রাজধানীসহ কিছু শহরের স্কুলের শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের কারণে এটি পারলেও দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে তা সম্ভব হবে না। ফলে তড়িঘড়ি করে যদি তাদের পরবর্তী শ্রেণিতে তুলে দিই, তাহলে তাদের শিক্ষাজীবনে অপূরণীয় ক্ষতি স্থায়ী হয়ে যাবে।

সবচেয়ে ভালো হয় যদি চলতি শিক্ষাবর্ষকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে মার্চের ১৫ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া যাবে। এর আগপর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের বর্তমান শ্রেণিতে থাকল। ২০২২ সালে এপ্রিল মাসে স্কুল বন্ধ থাকবে রমজানের ছুটির কারণে। এই ছুটির পর শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণির ক্লাস শুরু করতে পারবে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত জাতি হওয়ার জন্য আমাদের যে প্রত্যাশা, তার জন্য সমস্যা সমাধানে পটু প্রজন্ম তৈরিতে আমাদের কোনো ছাড় দেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। আর জানুয়ারি-ডিসেম্বর শিক্ষাবর্ষ এমন কোনো অতি আবশ্যক বিষয়ও নয় যে সেটি আপাত পরিবর্তন করা যাবে না।

মুনির হাসানপ্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান প্রধান