ফজল–এ –খোদার প্রতি হাজার সালাম

ফজল-এ-খোদা (৯ মার্চ, ১৯৪১–৪ জুলাই, ২০২১)

‘সালাম সালাম হাজার সালাম/সকল শহীদ স্মরণে...’ গানটি সম্ভবত: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’-এর পরে সাধারণ বাঙালির সবচেয়ে বেশি গাওয়া গান। এই গানটি ফজল-এ-খোদা’র লেখা, মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুর করা। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ২০০৬ সালে বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের সেরা ২০টি গানের তালিকায় ১২তম স্থান পায়। এই অবিনশ্বর গানের স্রষ্টা ফজল-এ-খোদা চলে গেলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার যখন, তখনো তিনি বেতারে কাজ করেন। বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। সরকারি কর্মচারী হয়েও ফজল-এ-খোদা লিখলেন এক কাব্যিক প্রতিবাদ ‘এমন তো কথা ছিল না...’। বশীর আহমেদের সুর আর মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া ফজল-এ-খোদার সেই গানটি ছিল ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/ পথের ধুলোয় লুটোবে/ সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহঙ্গ/ সহসা পাখনা লুটোবে/ এমন তো কথা ছিল না’।

অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা ফজল-এ-খোদা রোববার ভোর চারটায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মারা গেলেন। বয়স হিসেবে পরিণত বয়সেই মারা গেলেন; কিন্তু মারা গেলেন করোনায়, তাঁর জন্য একটি আইসিইউর ব্যবস্থা করা গেল না অবিরাম চেষ্টা করেও। দৃশ্যত তিনি জীবন্মৃত ছিলেন ৬-৭ বছর ধরেই, ছিলেন গভীর ডিমেনশিয়া ও কিডনি রোগে আক্রান্ত।

বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক ফজল-এ-খোদার জন্ম ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ, পাবনার বেড়া থানার বনগ্রামে। বাবা মুহাম্মদ খোদা বক্স এবং মা মোসাম্মাৎ জয়নবুন্নেছার প্রথম সন্তান ফজল-এ-খোদা। বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হন ১৯৬৩ সালে, ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে তিনি তালিকাভুক্ত হন।

ফজল-এ-খোদার বেশির ভাগ গান প্রাণ পেয়েছে বশীর আহমেদ, আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের কণ্ঠে। আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল দাশ গুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য, সত্য সাহার মতো সংগীতজ্ঞ ফজল-এ-খোদার গানগুলোতে সুর করেছেন। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ছাড়াও ১৯৭১-এ অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর লেখা গণসংগীত ‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে, দিন রাত অবিরাম’ গানটি সে সময় টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।

ফজল-এ-খোদার কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে: ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন রমণী চলে যায়’, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’, ‘প্রেমের এক নাম জীবন’, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো, পথের ধুলোয় লুটোবে’, ‘ডাক পিয়নে সারাটা দিন চিঠি বিলি করে বেড়ায়’। তাঁর ছড়া গ্রন্থের সংখ্যা ১০টি আর কবিতা গ্রন্থ ৫টি। এ ছাড়া গান, নাটক, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৩৩টি। ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর ফজল-এ-খোদা অসংখ্য দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোক সংগীত, ইসলামি গান লিখেছেন।

শিশু-কিশোর সংগঠন শাপলা শালুকের আসরের প্রতিষ্ঠাতা ফজল-এ-খোদা ‘মিতা ভাই’ হিসেবেই পরিচিত আমাদের কাছে। সত্তর দশকে শিশু-কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘শাপলা শালুক’ ফজল-এ-খোদার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো।

ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে আমাদের প্রজন্মের প্রেম রেডিও। রেডিওতে গান শুনেই ফজল-এ-খোদার সঙ্গে পরিচয়। প্রত্যক্ষ পরিচয় হলো শাপলা শালুকের আসর নিয়ে। আমাদের এলাকায় আসর গড়ে তুলেছিলাম আমরা স্কুলের কতিপয় শিক্ষার্থী, আমাদের লেখা এবং সংগঠনের খবর ছাপা হতো ‘শাপলা শালুক’-এ। মিতা ভাই, ফজল-এ-খোদা খোঁজ রাখতেন আমাদের।

অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা ফজল-এ-খোদা রোববার ভোর চারটায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মারা গেলেন। বয়স হিসেবে পরিণত বয়সেই মারা গেলেন; কিন্তু মারা গেলেন করোনায়, তাঁর জন্য একটি আইসিইউর ব্যবস্থা করা গেল না অবিরাম চেষ্টা করেও।

পেশার সূত্র ধরে ঢাকা আসার পর মিতা ভাই, ফজল-এ-খোদা অভিভাবক হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাজ করি ‘সংবাদ’-এ। ফজল-এ-খোদা একদিন হঠাৎ ডেকে বললেন ‘অডিশন দাও’। অডিশন কী বিষয় বুঝি না। স্বপ্নের বাড়ি রেডিও অফিসে ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের কল্যাণে ঢুকি এই যথেষ্ট। ফজল-এ-খোদা এবার ঢুকিয়ে দিলেন স্টুডিওতে। অডিশন হয়ে গেল, নির্বাচিতও হলাম, কিছুটা স্বজনপ্রীতিও ছিল বুঝি! যাওয়া-আসা শুরু রেডিওতে। মাথার ওপর ফজল-এ-খোদা। ‘সংবাদ’-এর শিফট শেষে আগারগাঁও রেডিও অফিস নতুন নেশা। বংশাল টু আগারগাঁও, কখনো শাহবাগ ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস। এ টেবিল ও টেবিল ঘুরি, কেউ বলেন দ্রুত স্ক্রিপ্টটা লিখে দিতে, কেউ বলেন ভয়েস দিতে। আগে কাজ, পরে কন্ট্রাক্ট সই। মাস শেষে কিছু বাড়তি পাওনা। চেকে যে অঙ্ক আসে তা দেখে ব্যাংকওয়ালারা হাসেন, বলেন, ‘কই পান এই ৭৫ টাকা, ১২৫ টাকার চেক।’ কিন্তু আমি জানি এই বাড়তি আয়টুকু আমার জন্য কত প্রয়োজন। পাবনা থেকে ঢাকায় আসা ফজল-এ-খোদা বুঝি বুঝতেন ঢাকায় নতুন আসা এক তরুণের সংকটের কথা। ফজল-এ-খোদার হাত ধরে সেই যে রেডিওতে পা রাখা, তা আজও চলছে।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা ক্ষীণ হয়ে আসে। তবে যোগাযোগ থাকে তাঁর তরুণ পুত্র সাংবাদিক সজীব ওনাসিস-এর সঙ্গে। ফজল-এ-খোদা ভাইয়ের চাকরি শেষ, অবসর, অসুস্থ হয়ে পড়া সবই ঘটতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। শেষ কয়েক বছর গভীর ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত এই কবি কবি নজরুলের মতোই স্মৃতিভ্রমে ভোগেন।

ফজল-এ-খোদা কেন কোনো জাতীয় পুরস্কার পাননি, সে প্রশ্ন করেছি অনেককে। কিন্তু কোনো জবাব পাইনি। কয়েক বছর ধরে সজীবের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ‘যথা নিয়মে’ কাগজপত্র জমা দিই, কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখে না। কোনো কোনো পদকজয়ী বলেন, ‘আমি তো কিছুই জানি না, আমাকে ডেকে নিয়ে পদক দেওয়া হয়েছে।’ ভাবি, আমার বার্তা সম্পাদক আব্দুল আওয়াল খানের কথাই সত্যি: এ দেশে এমন অনেকে পদক পান, যাঁদের আসলে পাদুকা পাওয়ার কথা। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু সজীব বলত, বাবার এখন যা অবস্থা, তাতে পদক পাওয়া না-পাওয়াতে কিছুই যায় আসে না, তবে জীবিত অবস্থায় পদক পেলে সেটি তাঁর গলায় ঝুলিয়ে আমরা সান্ত্বনা পেতাম। কিন্তু তা হলো না। স্ত্রী-পুত্রসহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, কিছুই করা গেল না তাঁর জন্য, এমনকি আইসিইউ সুবিধাও নিশ্চিত করা গেল না।

আমার জীবনসংগ্রামের কঠিন সময়ের অভিভাবক মনে করি তাঁকে। কিন্তু একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে ফজল-এ-খোদার প্রতি রাষ্ট্রেরও তো দায় আছে! সেই দায় তাঁর জীবিত অবস্থায় কেউ মেটাল না। ফজল-এ-খোদার প্রতি হাজার সালাম।

মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক