ফিরে চাই আমার মাঠ

চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম মাঠের এক পাশে সুইমিংপুলের নির্মাণকাজ চলছে। চট্টগ্রাম নগর, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম মাঠের এক পাশে সুইমিংপুলের নির্মাণকাজ চলছে। চট্টগ্রাম নগর, সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর ১২ অক্টোবর সংখ্যায় চট্টগ্রামের মাঠের বর্তমান হাল-হকিকতবিষয়ক সচিত্র প্রতিবেদনটি দেখতে দেখতে বাল্য-কৈশোরের স্মৃতিরা এসে ভিড় জমাল। চট্টগ্রামে আমাদের পৈতৃক বাড়ির ছাদে উঠলেই দেখা যেত রাস্তার ওপারে সবুজে মোড়া আউটার স্টেডিয়াম, তার ওপারে মূল স্টেডিয়াম। তারও ওপারে আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা উঠে গেছে বাটালি পাহাড়ের মাথায়। ডানে চৈনিক শিল্পীর গড়া নয়নাভিরাম সার্কিট হাউস, তার চারপাশে গড়ানো বিস্তৃত মাঠ, এক পাশে শালবীথিকার ছায়াঢাকা এলাকা। পাহাড়-টিলা আর নানা দুর্লভ বৃক্ষে ছাওয়া চট্টগ্রাম নগরী ছিল সত্যিই এ অঞ্চলের রানি। ১৯৭৪ সালে বন-গবেষণাগারে কর্মরত এক বিদেশি আমাকে বলেছিল, ‘দেখো, আমি পৃথিবীর অন্তত ৫০টি দেশে গেছি, পাহাড়ের ঢালে অনেক নগর দেখেছি, কিন্তু শহরের মাঝে মাঝে পাহাড়, এমনটি খুব কম। এটি অনন্য, তোমরা একে নষ্ট কোরো না।’

আমাদের ছোটবেলায়, মূলত গত শতকের ষাটের দশকে, আউটার স্টেডিয়ামটিতে অন্তত চারটি ফুটবল ম্যাচ খেলার পরিসর ছিল, অর্থাৎ আটটি দলের ৮৮ জন খেলোয়াড় ফুটবল অনুশীলন করতে পারত, আরও অন্যান্য মাঠ তো ছিলই। আমাদেরও ফুটবল-ক্রিকেটের যেটুকু চর্চা, তার সবটাই এ মাঠে। এর ফলও হাতে হাতেই ছিল, জাতীয় দলে ফুটবলার সরবরাহে চট্টগ্রামের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আর ক্রিকেটে তো চট্টগ্রামের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য, প্রথম দিককার জাতীয় দলে অর্ধেকের বেশি ছিল চট্টগ্রাম থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়েরা, আউটার স্টেডিয়ামের মাঠে বেড়ে ওঠা তামিম ইকবালই হয়তো এর শেষ রশ্মি। এটি ছাড়াও সার্কিট হাউসের সুবিস্তৃত প্রাঙ্গণে আরও অন্তত তিনটি খেলার মাঠের মতো পরিসর ছিল। আমাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় স্মৃতির অনেকখানি সরবরাহ করেছে এই সব মাঠ, আশপাশের ঝোপঝাড়, রেলওয়ে এলাকার বিশাল ছায়াময় বৃক্ষরাজি।

আউটার স্টেডিয়ামের ওপর প্রথম আক্রমণটি আসে অবশ্য যথানিয়মে সরকারের তরফ থেকে, এর এক কোণ ঘিরে তৈরি হয় পিডিপির পাওয়ার স্টেশন। তবে বড়সড় ক্ষতির সূচনা এরই রক্ষাকর্তা চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা সিজেকেএসের হাতে। প্রথমে তারা মাঠটির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বিশাল একটি মার্কেট নির্মাণ করে। এরপর আউটার স্টেডিয়ামের পুব দিক সম্পূর্ণ বন্ধ করে মাঠটিকে প্রায় অবরুদ্ধ করে মার্কেট নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু করে। আমি এর বিরুদ্ধে তৎকালীন ভোরের কাগজ-এ একটি নিবন্ধ লিখি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর এক কর্নেল সাহেব আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপর লক্ষ করি, নির্মাণকাজ বন্ধ হয়েছে। এসব দেখে মনে হয়, কর্তৃপক্ষের খেলাধুলার চেয়ে মার্কেট ব্যবসায় আগ্রহ বেশি। মূল এম এ আজিজ স্টেডিয়াম মাঠটির শতকরা ১০ ভাগ বছরে ব্যবহৃত হয় কি না, সন্দেহ। একটি নির্জীব বাৎসরিক ফুটবল ও ক্রিকেট লিগ আর ছিটেফোঁটা কিছু প্রতিযোগিতা ছাড়া এখানে আর কিছু হয় বলে জানি না।

আরেকটি চরম অবিবেচকের কাজ করে আরও কিছু জায়গা নষ্ট করা হয়েছে। বহু অর্থ ব্যয় করে এখানে বসানো হয়েছে ফ্লাডলাইট। শুনেছি, এ আলোয় ফুটবল সম্ভব, ক্রিকেট সম্ভব নয়। তা ছাড়া ক্রিকেট চলে গেছে নবনির্মিত জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে, আর ফুটবলের যা দশা, ফ্লাডলাইটের আলোয় ফুটবল অন্তত আজকে অলীক স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। স্টেডিয়ামের সামনের অংশে জিমনেসিয়ামটিরও প্রায় একই দশা, এর ব্যবহার সুস্বাস্থ্য গড়ার কাজে যতটুকু, তার চেয়ে বেশি বিভিন্ন মেলা-প্রদর্শনীর জন্য ভাড়া দেওয়ার কাজে।

আউটার স্টেডিয়ামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘিরে বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে সুইমিংপুল। খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত এ উদ্যোগের বিরোধিতা সমীচীন নয়। তবু আশঙ্কা থেকে যায়, এটিও না শেষ পর্যন্ত মৎস্য চাষ বা কোনো ভাসমান পুষ্পমেলার কাজেই অধিক ব্যবহৃত হয়। মাঠটির বাকি অংশের মাঝখানটি প্রায় সংবৎসর ভাড়া খাটে বিবিধ-বিচিত্র মেলার জন্য। পেছনের দিকটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, শুনলে বিশ্বাস হয় না, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ট্রাক রাখার কাজে! আর সামনের দিক? সেটিকে এখন নগরীর বৃহত্তম ভাগাড়ের তকমা দেওয়া চলে। যে কেউ পূতিগন্ধময় আবর্জনা এখানে ফেলতে পারেন, এ জন্য তাঁর পূর্ণ নাগরিক স্বাধীনতা আছে। খেলাধুলা ফাঁকে ফাঁকে চলতে পারবে, না চললেও ক্ষতি নেই। একটি মূল সড়কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে এ নারকীয় দৃশ্য কী করে নগরের বড়-মেজ-ছোট কর্তাদের চোখে পড়ে না, তা ভেবে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

সে পৈতৃক বাড়িতে এখন আমরা আর থাকি না, তবে আউটার স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে আমার ছোটবেলার খেলার মাঠটির আজকের অবস্থা দেখে চোখের জল ফেলতেও লজ্জা হয়। অথচ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরীর, সোহাগ করে যাকে বাণিজ্যিক রাজধানীও ডাকা হয়, কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত আউটার স্টেডিয়ামটির এমন দুরবস্থা বেশি দিনের কথা নয়। বছর কয়েক আগেও পাশের ফুটপাতে বসে বাদাম চিবাতে চিবাতে শখানেক দর্শককে বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়া আর ছেলেপিলেদের ফুটবল উপভোগ করতে দেখেছি। উন্মুক্ত পরিসর, গাছপালা, ঝোপঝাড়, শিয়াল-বেজি-কাঠবিড়ালিদের সংসর্গ যে নীরবে শিশু-কিশোরদের জীবনে কতখানি ভূমিকা রাখে, তা আজকের ওই বয়সীদের সঙ্গে আমার বাল্য-কৈশোরকে মেলালে সহজেই অনুধাবন করতে পারি।

কেউ বলবেন, আপনার বাল্যে এ শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৪-৫ লাখ, এখন কারও মতে ৪০, কারও মতে ৬০ লাখ। এ অবস্থায় ওই জায়গা আগের মতো থাকবে কী করে? এ ধারণা যুক্তিপ্রসূত নয়। কারণ, স্টেডিয়াম, আউটার স্টেডিয়াম, সার্কিট হাউসের জায়গা নাগরিকদের কেউ দখল করেনি। আমাদের অবিমৃশ্যকারিতাই এর জন্য দায়ী। উল্লিখিত স্থানগুলো ছাড়া ও আশপাশের নেভি ও রেলওয়ের নয়নাভিরাম জায়গাগুলোও প্রায় অবিকৃত অবস্থায় আছে। নগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এ সম্পূর্ণ পরিসরটিকে অবিকৃত রেখে চট্টগ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উন্মুক্ত স্থান হিসেবে পরিণত করতে খুব বেশি অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজনও নেই, শুধু চাই খেলাধুলা আর প্রকৃতি-সংসর্গের প্রয়োজনীয়তার প্রতি সংবেদনশীল মন আর দক্ষ পরিবেশ-স্থপতির সহযোগিতা। তবে খেলার মাঠের জন্য যথেষ্ট পরিসর আর সেটি সর্বসাধারণের, বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুণদের, খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত রাখা আবশ্যক।

আশা করি, কর্তৃপক্ষ অন্তত আউটার স্টেডিয়ামটির করুণ কান্না শুনতে পাবে এবং সম্পূর্ণ এলাকাটির জন্য একটি উপযুক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে।

আবুল মনসুর: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও শিল্পসমালোচক।