ফিলিস্তিন, ও ফিলিস্তিন: ঈদকালীন হত্যা ও জায়নবাদ

কোনো ইসরায়েলি নেতা রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়লেই ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে
ছবি: এএফপি

ইসরায়েল মাত্র দুই সময় হত্যা চালায়—যুদ্ধে ও শান্তিতে। গাধা যখন বোঝা বয় তখনো সে গাধা, যখন বয় না, তখনো সে গাধাই থাকে। স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক সব পরিস্থিতিতেই ইসরায়েল আগ্রাসী। ইসরায়েল এক দখলদার সামরিক যন্ত্র, যার কাছে মানবিকতা আশা করা ভুল। গত শতকের এক ইউরোপীয় কৌতুকের মধ্যে জায়নবাদীদের মানসিকতাটা ধরা পড়ে। এক ইহুদি যুবক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছে। তো তার মা তার ব্যাগে খাবার-দাবার গুছিয়ে দিয়ে বলছে, ‘শোন বাবা, বেশি পরিশ্রম করবি না। একটা করে তুর্কি মারবি আর জিরিয়ে নিবি।’ তখন ছেলে বলছে, ‘মা, কিন্তু ওরা যদি আমাকে মারে?’ মায়ের উত্তর, ‘তোকে মারবে কেন, তুই ওদের কী ক্ষতি করেছিস?’ ইসরায়েল পবিত্র রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে মুসলমানদের যেতে দেবে না, জায়নবাদী ফ্যাসিস্টরা সেখানে আগুন দেবে। কিন্তু প্রতিবাদের নাম দেবে ‘সন্ত্রাস’। নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ হত্যার জবাবে গাজা থেকে রকেট ছোড়া হলে শহরটার ওপর লাগাতার বোমাবর্ষণ করে বলবে, ‘এই হলো আমাদের আত্মরক্ষার অধিকার।’ প্রেসিডেন্ট বদলায়, কিন্তু মার্কিন প্রশাসন তোতাপাখির মতো আওড়ে যায় ইসরায়েলের আত্মরক্ষার কথা।

ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন চলতে থাকবে, জেরুজালেম থেকে সব ফিলিস্তিনিকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, ফিলিস্তিনের বৈধ রাজধানীকে নিজেদের রাজধানী বলে ঘোষণা করবে; তবুও আত্মরক্ষার অধিকার থাকতে পারবে না ফিলিস্তিনিদের! তারা কি মানুষ না?

আরব ও মুসলমানরা বেশির ভাগ সময় ইহুদিদের বন্ধু থেকেছে। কয়েকটি ঘটনা বাদ দিয়ে আরব কিংবা আন্দালুসিয়ার মুসলিম শাসনে ইহুদিরা সম্মানিত থেকেছে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগের ইতিহাসে ইহুদি ও মুসলমানদের হানাহানির ঘটনা বিরল।

মদিনায় আক্রমণকারী কুরাইশদের পক্ষ নেওয়ার জন্য ইহুদিদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইহুদি নেতারাই ইহুদি আইন মেনে সেটা করেছিলেন। আরব ও মুসলিম অঞ্চলই ছিল ইউরোপ থেকে পালানো ইহুদিদের আশ্রয়। দ্বিতীয় উমাইয়া রাজত্বের গ্রানাডায় ইহুদিরা কেবল সম্মানিতই হতো না, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক কর্তাও ছিল। সে কারণেই গ্রানাডা পতনের পর বিজয়ীরা ইহুদিদের আদেশ দেয়, হয় খ্রিষ্টান হও নয়তো দেশ ছাড়ো। প্রায় ৭০ হাজার ইহুদি খ্রিষ্টান হয়ে থেকে যায় কিছুদিনের মধ্যেই আবারও বিচারের তোপে পড়ার জন্য, যাকে বলে ইনকুইজিশন। বাকিরা পর্তুগালে ও উসমানিয়া সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর সাত বছর পর স্পেনের মুসলিমদেরও বলা হয়, হয় খ্রিষ্টান হও নয়তো দেশ ছাড়ো।

বরং ইউরোপ, খ্রিষ্টীয় চার্চ লাগাতারভাবে ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে, গণহত্যা করেছে। হিটলারের ইহুদি গণহত্যায় পরোক্ষে মদদ ছিল তখনকার রোমান ক্যাথলিক পোপের। ‘আমেন’ নামে তথ্যচিত্রে তার প্রমাণ রেখেছেন গ্রিক–ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক কস্তা গাভরাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক ইহুদি আশ্রয় নিয়েছিল সিরিয়ায়। তেমনি মধ্যযুগে ইউরোপের নির্যাতিত ইহুদিরা আশ্রয় পেয়েছিল মুসলিম স্পেনে। মুসলিম শাসন অবসানের পর অনেক ইহুদি আরবদের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকায় চলে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

হিটলার করেছিল গণহত্যা আর মিত্রশক্তি ইহুদিদের চালান করে দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের বুকের ওপর। পশ্চিমা প্রভুদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে আরবের বুকে ইসরায়েলকে সাম্রাজ্যবাদী পাহারাদার হিসেবে বসানো এবং নিরন্তর শক্তিশালী করে যাওয়া হয়েছে। এখনো বিপুল মার্কিন তহবিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পায়।

প্রশ্ন হলো, ঠিক এই সময়ে ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনিদের ওপর চড়াও হলো? চলমান ঘটনার শুরু পূর্ব জেরুজালেমে কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদ দিয়ে হলেও, কারণটা রাজনৈতিক। ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। ঘুষ নেওয়ার অপরাধে তাঁর জেলে যাওয়ার কথা। সাম্প্রতিক নির্বাচনেও তাঁর দল ভালো ফল করেনি। কোনো ইসরায়েলি নেতা রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়লেই ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে। এটাই তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক থাকার উপায়। পাশাপাশি ইসরায়েলের নাগরিকদের মধ্যে তীব্র ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তার ঘটেছে। তাদের চাপেও ইহুদিবাদী নেতাদের আগ্রাসী আচরণ দেখাতে হয়। নেতানিয়াহুও জনপ্রিয়তার ঘাটতি মেটানো এবং নিজেকে ইহুদিদের ত্রাতা হিসেবে দেখাতে ফিলিস্তিনি হত্যার পুরোনো কৌশল নিয়েছেন।

আগের যেকোনো সময়ের চাইতে ইসরায়েল অনেক সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে মিসরের কারণে। মিসরের জেনারেল সিসির স্বৈরশাসন কেবল মিসরীয়দের দমন করছে না, গাজা সীমান্ত বন্ধ রেখে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি অবরোধও বাস্তবায়ন করছে। তিন দিকে ইসরায়েলি অবরোধ থাকলেও তা সফল হতো না, যদি মিসর গাজা সীমান্ত খুলে রাখত। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে মিসরের এই আচরণ অবশ্যই শত্রুরাষ্ট্রীয় আচরণ। আরব বন্ধুত্ব ও মেহমানদারির কথা যেমন সুবিদিত, তেমনি সুবিদিত তাদের অনেকের বিশ্বাসঘাতক চরিত্র। একের পর এক আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে আরব জনতার সঙ্গে বেইমানি করছে, পিঠে ছুরি মারছে ফিলিস্তিনিদের আর বাড়াচ্ছে অনৈক্য।

বিশ্বাসঘাতকদের তালিকায় ফিলিস্তিনের নামকাওয়াস্তের সরকারের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও আছেন। ইসরায়েলিদের হয়ে ফিলিস্তিনের প্রতিবাদ ভন্ডুল করায় কাজ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনে হারার ভয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তিনি স্থগিত করেছেন। যে প্রতিরোধ ফিলিস্তিনিরা চালাচ্ছে, তা অনেকটাই নেতৃত্ববিহীন। যে মাটিতে শিশুরা জন্মেই দেখে হত্যা, নির্যাতন আর দাসত্ব, সেই মাটির সন্তানদের স্বাধীনতার চেতনা শেখাতে হয় না। সৌদি-ইসরায়েলি আঁতাত যতই গভীর হোক না কেন, ফিলিস্তিনিদের বাঁচার লড়াইও তাই থামবার নয়।

এবারও অনেক ফিলিস্তিনি মারা যাবেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুললেও তার বিচার হবে না। নেতানিয়াহু চরম দক্ষিণপন্থী ঠেঙ্গাড়েদের নিয়ে হয়তো কোয়ালিশন সরকার গঠন করে টিকে যাবেন, যার বলি হচ্ছে ফিলিস্তিন। কিন্তু একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিনি ঐক্যের। মাহমুদ আব্বাসদের বাদ দিয়েই সেই ঐক্য হতে পারে।

ইসরায়েলের অবশ্যই টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিনিরাও তা মেনে নিয়েছে। তাদের দাবি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর দখল করা পূর্ব জেরুজালেমসহ আরব ভূমি ফেরত দেওয়া হোক। দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের অংশ হিসেবে তারা জেরুজালেমকে উভয় দেশের রাজধানী করাতেও রাজি। কিন্তু ইসরায়েল তুলছে মিথের দাবি। প্রাচীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের কথা বলে তারা সবকিছু জায়েজ করতে চায়। কিন্তু ইতিহাসে ইসরায়েল বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির ইহুদিদের এক জাতি বলে ভাবাও ছিল অকল্পনীয়। সমস্যাটা আকাশ থেকে পাড়লেন ইসরায়েলের স্বপ্নদ্রষ্টা অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক থিয়োডর হার্জেল। ‘জুডেনস্টাট’ বা ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ নামে ১৮৯৬ সালে তিনি যে বই লেখেন, তা হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্ফে’র মতোই বিপজ্জনক। হার্জেল লেখেন, ‘আমরা সেখানে (ফিলিস্তিনে) এশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের দুর্গপ্রাচীর বানাব।’ ব্রিটেনও চাইছিল তুর্কি উসমানিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে আরবে ভারতের মতো স্বর্ণপ্রসবা উপনিবেশ বসাতে। এ জন্য স্বাধীন আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরবদের তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উসকায়। শিয়ালের কাছে মুরগি জিম্মায় বিশ্বাসী মক্কার আমির আর মিসরীয় মোল্লারা ব্রিটেনকে সাহায্য করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত উসমানীয় সাম্রাজ্যের আরব অংশ ব্রিটেনের হাতে যায়। তারা দুটি রাষ্ট্র বানানো শুরু করে, একটা হলো সৌদি আরব অন্যটা ইসরায়েল। এরা তাই জন্মের ভাই, তাদের ধাত্রী ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই এরা এশিয়ায় পাশ্চাত্যের কেল্লা এবং দুজন দুজনার। মধ্যপ্রাচ্যের যাবতীয় সমস্যার গোড়া হাতালে এঁদেরই পাবেন।

হিটলারের ইউটোপিয়ার শিকার হয়েছিল দুই কোটি মানুষ আর জায়নবাদী হার্জেলের ইউটোপিয়া হলো মধ্যপ্রাচ্যের অভিশাপ। জায়নাবাদী নেতারা যে রাষ্ট্রচিন্তা করলেন, তা আদা আর কাঁচকলা তথা সম্প্রদায় ও জাতির মিশেল। এই দুটি পদার্থ একসঙ্গে করলে অখাদ্য হয়, দুর্গন্ধও হয়। সম্প্রদায়কে জাতি বলে ঘোষণা করায় সেটাই ঘটল।
পৃথিবীতে ইহুদি জাতি বলে কিছু নেই। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস প্রাচীন, কিন্তু জাতীয়তাবাদের ইতিহাস বড়জোর ৩০০ বছরের। আজকের পৃথিবীতে যেসব জাতি ও জাতিরাষ্ট্র আছে, তারা অতীতে এভাবে পরিচিত হতো না। দুনিয়ায় কোনো বিশুদ্ধ জাতি নেই, অথচ জায়ানাবাদীদের দাবি অনাদিকাল থেকে কেবল তারাই তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় বিশুদ্ধতা অটুট রাখতে পেরেছে। তাদের রক্তই কেবল বিশুদ্ধ, বাকিরা ভেজাল। ঠিক একই দাবি হিটলারের নাজিবাদও করত।

অথচ ডিএনএ পরীক্ষা সে কথা বলে না। বিশুদ্ধ জাতির দেশ ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার ১২৬টি জাতির মধ্যে ‘ইসরায়েলি’ বলে কেউ নেই। বাইবেল কথিত ‘ল্যান্ড অব ইসরায়েল’ ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝাত না, বোঝাত ইহুদিদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে। বাস্তবে ইহুদিরা ছিল কেনান ও জুডাহ নামের অঞ্চলে। খ্রিষ্টজন্মের আগে ও পরে মাত্র কয়েক শ বছর জেরুজালেমে ইহুদি রাজত্ব থাকার প্রমাণ মেলে। কিন্তু এর ভিত্তিতে প্রাচীন নগরীর সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস ও বর্তমানের মালিকানা দাবি করা নিপাট অন্যায়। তা ছাড়া ৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম থেকে ইহুদিদের বিতাড়নেরও প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণও নেই।

মিসর থেকে ইহুদিদের দেশান্তরের মিথেরও সত্যতা দুর্লভ। ইসরায়েলে বসবাসকারী ইহুদিদের ৯০ শতাংশও নৃতাত্ত্বিকভাবে আদি বনি ইসরায়েল বা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পুত্র ইসহাকের বংশধর না। বরং তাঁদের রক্তে বইছে মধ্যযুগীয় পূর্ব ইউরোপীয় খাজারি রাজত্বের অধিবাসীদের রক্ত—পনেরো শতকে খ্রিষ্টান ও মোঙ্গল আক্রমণে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তারা। এই ইউরোপীয় ইহুদিরা হিব্রু ভাষায়ও কথা বলত না। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্লোমো স্যান্ডের বেস্ট সেলার বই ‘দ্য ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল’ এবং ‘দ্য ইনভেনশন অব দ্য ল্যান্ড অব ইসরায়েল’ জায়নবাদীদের যাবতীয় দাবিকে অথই পানিতে ফেলে দিয়েছে।
স্লোমো স্যান্ড দাবি করেছিলেন, আজকের ফিলিস্তিনিদের মধ্যেই আদি বনি ইসরায়েলের বংশধরদের রক্ত বেশি প্রবাহিত আর ফিলিস্তিনিরাই আসলে মুসলমান হওয়া আদি ইহুদি। আর যিশুও ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি যুবক। ইতিহাসের পরিহাস এই, ইসরায়েল ইহুদিবাদের নামেই আদি ইহুদিদের বংশধর আজকের ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে। এমনকি ঈদের দিনেও তাদের জন্য মানবতা নেই।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]