ফেব্রুয়ারি কাছে এলে

ভাষা নিয়ে আমরা কথা বলি ভাষার মাসে। তার পরের মাসে আর ভাষার কোনো দেখা নেই। এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফেসবুক একটি অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক মাধ্যম। সেখানে কী হচ্ছে একটু দেখা যাক। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে সেখানে আমাদের ভাষাটি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছি। যে যেভাবে পারছে, ভাষার তেরোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আঞ্চলিক কথা ব্যবহার করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু খিচুড়ি? সেটা কি ঠিক হবে? প্রমিত বাংলা শেখার সবচেয়ে ভালো জায়গা ভালো পত্রিকাগুলো। সেখানকার সাহিত্য সাময়িকীতে জায়গা করে নিয়েছে খিচুড়ি ভাষা।

এটা কি আমাদের জন্য ভালো হচ্ছে, না খারাপ? আমি মনে করি খারাপ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষিত লোকদের উচিত হবে প্রমিত বাংলার ব্যবহার। বইমেলায় গিয়ে যদি দেখি ছেলেমেয়েরা খিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করছে, তাহলে মন খারাপ হবে। সেই খিচুড়ির সঙ্গে যোগ হয়েছে ইংরেজি। অর্থাৎ বাক্যের অর্ধেক ইংরেজি, অর্ধেক বাংলা। এটা কি ভালো হবে? আমার মনে হয় খারাপ হবে।

আমাদের ক্লাসে ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শুনতে ভালোবাসে। আমাদের মাধ্যম ইংরেজি। তাই ভাষার প্রয়োগে আমি ইংরেজিতেই কথা বলি। কিন্তু যখন অন্তরঙ্গভাবে নজরুলকে বোঝাতে চাই, তখন আমি গান গাই। সেই গানগুলো, যার অনুবাদ হয় না। আমার কণ্ঠে তারা প্রেম বুঝতে পারে, ভালোবাসা বুঝতে পারে, বিরহ বুঝতে পারে। তখন আমি বাংলায় চলে যাই এবং ওদের বোঝাতে চেষ্টা করি, যত দিন মাকে ভালো না বাসবে, তত দিন তোমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না। তোমাদের ভালোবাসা হবে কৃত্রিম। যদি ভালো করে বাংলা বলতে না পারো, তাহলে কোনো দিন ভালো ইংরেজিও শিখতে পারবে না। ইংরেজি শিখতে হলে যেমন সবচেয়ে সুন্দর ইংরেজি বইগুলো পড়বে বালিশের নিচে রেখে। যেমনটি আমার নাতি-নাতনিরা করে। তারা রাত দুইটা পর্যন্ত সেই উপন্যাসগুলো পড়তে থাকে। টেলিভিশন দেখে না, বই পড়ে। বই পড়ার অভ্যাস করতে করতে ইংরেজি এমনভাবে রপ্ত করেছে যে আমি নিজেই অবাক।

বাংলাকে ভালোবাসা আর বাংলা চর্চা করা দুটো আলাদা বিষয়। বাড়িতে চর্চা নেই, স্কুলে চর্চা নেই, কলেজে চর্চা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা নেই, তাই সবটুকুই ‘অমনি হবে’? হবে না। বাংলার চর্চা অব্যাহত থাকতে হবে। যাঁরা প্রমিত বাংলায় বক্তব্য দেন, তাঁদের বক্তব্য বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। এমন একজনের নাম মনে পড়ছে, যাঁর কথা আজও ভুলতে পারিনি। মুনীর চৌধুরী। আমি তাঁর বাংলা বা ইংরেজি ক্লাসের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু ওনার ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম শুধু প্রমিত বাংলা বা ইংরেজির কারণে। এখনো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য শোনার জন্য আমি প্রস্তুত। এমনই সুন্দর তাঁর বাক্য নির্মাণ এবং বাক্যের ব্যবহার যে মনে হয় এ বক্তব্য সারা দিন ধরে শুনি।

সম্প্রতি আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানকার ছেলেমেয়েরা ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলে না। ইংরেজি বললে খুব ভালো অ্যাকসেন্টে কথা বলে। বোঝা যায় ওরা ভালো স্কুলের ছাত্রছাত্রী, ভালো শিক্ষকের কাছে পড়েছে। আমরা যারা সেন্ট গ্রেগরিতে পড়েছি, তাদের ইংরেজি একদম আলাদা। অনেকে আমার ইংরেজি শুনে অবাক হয়। ভাবে আমি বিলেতে পড়াশোনা করেছি। সে সুযোগ আমার ঘটেনি। আমার ভাই ও বোন দুজনেই বিদেশে পড়াশোনা করেছে। তাদের ইংরেজি অ্যাকসেন্ট আমার চেয়ে অনেক ভালো।

কিন্তু গ্রেগরিতে পড়ায় এবং আমি সব সময় এ বিষয়ে সতর্ক থাকায় আমার অ্যাকসেন্ট সবাইকে অবাক করে। বাংলায়ও তা-ই। কখনো মিশাল বাংলায় কথা বলবেন না, তাহলে আপনার বাংলা হয়ে পড়বে সত্যিকার অর্থে বিপর্যস্ত। আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা চেষ্টা করছে, যাতে প্রতিদিন প্রমিত বাংলায় কথা বলা সম্ভব হয়। ক্লাসে তুই-তোকারি করা বারণ করে দিয়েছি। সব সময় ভালো বাংলা বলার জন্য চেষ্টা করতে বলেছি। বইয়ের বাংলা নয়। কথ্য বাংলা। কিন্তু সুন্দর করে বলতে হবে। যদি ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রাণের মাস হয়ে থাকে, যদি বসন্তের আবাহনী হয়ে থাকে, যদি নতুনের আবরণে আনে নব সূর্যের আলো, তাহলে তা হতে হবে প্রমিত বাংলার চর্চায়।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।