ফেরদৌস-দৌলা খান (বাবলু)

শহীদ বুদ্ধিজীবী, কবি, অভিনয় শিল্পী, মালোপাড়া, রাজশাহী

ফেরদৌস–দৌলা খান (বাবলু)

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ফেরদৌস-দৌলা খান (বাবলু) দুটি বিষয়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন—সাহিত্যচর্চা ও অভিনয়।

সাহিত্যে তাঁর লেখার বিষয় ছিল কবিতা। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচার নিয়ে প্রতিবাদী কবিতা লিখতেন।

অবশ্য সেগুলো লিখতেন ছদ্মনাম ফেদাইন বেগম নামে। কিন্তু অনেকেই জানত, বুঝতে অসুবিধা হয়নি এই নামের আড়ালে আসল মানুষটি কে। রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।


একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি তাঁর কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় অনেক হাতবোমা বানিয়েছিলেন।

সেগুলো শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফাটিয়ে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল রাজশাহী শহরের পাকিস্তানি–সমর্থকদের ভয় দেখানো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর এই দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড আরও বেড়ে যায়।
২৬ নভেম্বর ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের স্থানীয় কমান্ডারের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। স্বাধীনতার পর বধ্যভূমিতে তাঁর গলিত মরদেহ পাওয়া যায়।

কোথায় ও কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সে তথ্য জানা যায়নি।

ফেরদৌস-দৌলা খান সম্পর্কে জানা যায় রাজশাহীর বিশিষ্ট সাংবাদিক ও আইনজীবী প্রয়াত সাঈদউদ্দীন আহমদের ‘আমার অনুজপ্রতিম’ রচনা থেকে।

তিনি লিখেছেন, ‘ফেরদৌস-দৌলা খান বাবলুর শিরায় শিরায় বইত বিদ্রোহের আগুন। প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন ও পরে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই—এ বিশ্বাস তাঁকে নির্ভীক বিপ্লবী করে তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই তিনি রণকৌশল রপ্ত করতে শুরু করেছিলেন।

কমরেডদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন রেডিও ট্রান্সমিটার, পরে ডিনামাইট। যেগুলো তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন পাকিস্তানি সামরিক কনভয়ের ওপর। বাবলু অনেকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন।

১৯৭০ সালের ১৬ আগস্ট পুলিশ তাঁকে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের প্ররোচনায় গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এক মাস পর রাজশাহীর আইনজীবী আতাউর রহমান তাঁকে জামিনে মুক্ত করেন। এ কথা বাবলু তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন।


একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাজশাহীতে ৮৪টি আর্মি ট্রাকের প্রথম কনভয় প্রবেশ করে। এ সময় অসীম সাহসের সঙ্গে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে উন্নত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সামনাসামনি আবার কখনো চোরাগোপ্তা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ফেরদৌস-দৌলা খান।

পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহর দখল করে নিলে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে চলে যান।

ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আবার রাজশাহী ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।

একই সঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের সহায়তায় চাকরি করতে থাকেন।

এখান থেকেই একাত্তরের ২৬ নভেম্বর এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ইপিকাফ কমান্ডার রিয়াজউদ্দিনের সহায়তায় পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন চাকরিস্থল থেকে ধরে নিয়ে যায়।

কালো কাপড়ে দুজন বাবলুকে চিনিয়ে দেয়। তারপর আর ফিরে আসেননি বাবলু। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক শহীদ পরিবারের মতো তাঁর বৃদ্ধ বাবা ও ভাই পদ্মার তীরে বাবলা বনের বধ্যভূমিতে বাবলুর গলিত মৃতদেহ খুঁজে পান।

ঘি রঙের প্যান্ট, নীল শার্ট, ব্রাউন সোয়েটার ও তাঁর এক পাটি সুয়েট লেদারের জুতা দেখে তাঁরা নিশ্চিত হন, এখানেই ফেরদৌস-দৌলা খানকে এনে আরও অনেকের সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে।


ফেরদৌস-দৌলা খানের (বাবলু) জন্ম রাজশাহীর মালোপাড়ায়। বাবা ফিরোজ-দৌলা খান, মা হেলেন খাতুন। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও দুই বোন।

ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বড় হয়ে ওঠা, লেখাপড়া—সবই রাজশাহীতে।

ম্যাট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন রাজশাহী সিটি কলেজে (নৈশ)। সত্তরে বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় চাকরি নেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইপিডাইস্কোপ অপারেটর হিসেবে।


ফেরদৌস-দৌলা বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক ছিলেন। তাঁর সব পারিবারিক বৃত্তান্ত অনেক চেষ্টা করেও জানা সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের মনে বিভিন্ন ঘটনায় ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে। এ কারণে তাঁর সম্পর্কে তাঁরা কিছু বলতে চান না।

তাঁর ব্যাপারে এখন আর তাঁদের উৎসাহ নেই। শহীদ পরিবার হিসেবে তাঁরা এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো স্বীকৃতি পাননি।


প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে। (সংক্ষেপে ইপিসিএএফ বা ইপিকাফ। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকার ইপিআর বাহিনী বিলুপ্ত করে এই বাহিনী গঠন করে। এর বেশির ভাগ সদস্য ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের অধিবাসী বা অবাঙালি)।


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]