ফেসবুক স্ট্যাটাস, নাকি হামলার কারণ ভূমি দখল ?

দেড় ঘণ্টা ধরে বাড়িতে বাড়িতে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা

বেশ কয়েক বছর ধরেই ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। দৃশ্যত প্রতিরোধহীনভাবেই এটি চর্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি এমনই হামলার শিকার হয়েছেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেক মানুষ। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি, সেখানে ৯০টি ঘরবাড়ি ও ১০ থেকে ১২টি মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। ভয়ে অনেকেই অন্যত্র সরে গেছেন। নারী ও শিশুরা ঘরে থাকতে পারছে না। দুজন নারী বিবিসিকে বলেছেন, হামলার আগেই তাঁরা পালিয়ে পার্শ্ববর্তী বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শুধু তাঁরা নন, বহু নারীই প্রাণ বাঁচাতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকেই নিজেদের বাড়িঘর তছনছ হওয়ার দৃশ্য তাঁরা দেখেছেন। দেড় ঘণ্টা ধরে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা। এ সময় তাঁদের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসেনি। (বিবিসি ১৮ মার্চ)

বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, ১৫ মার্চ দিরাইয়ে শানে রিসালাত নামে এক সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের এক বক্তার দেওয়া বক্তব্যের জের ধরে ঝুমন দাশ নামের একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন। প্রতিবাদে হেফাজত পরে সমাবেশও করে। গ্রেপ্তার হন ঝুমন দাশ। কিন্তু তারপরও হামলা থেকে রক্ষা পাননি স্থানীয় হিন্দুরা।

বাংলাদেশে ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে প্রথম সাম্প্রদায়িক হামলাটি হয় ২০১২ সালে। পবিত্র কোরআন শরিফকে অবমাননা করে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে—এ অভিযোগে ওই বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। এর পরপরই উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায়ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। দুদিনের এই সহিংস ঘটনায় আহত হন রামু ও উখিয়ার বহু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯টি বৌদ্ধবিহার। এ সময়ও এলাকা এবং দেশ ত্যাগ করে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ পরিবার। যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেই উত্তম কুমার বড়ুয়ার কোনো খোঁজ হামলার দিন রাত থেকে আজ পর্যন্ত মেলেনি।

চার বছর পর আবারও ঘটে একই ধরনের হামলা। রসরাজ দাস নামের একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সদরে হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলায় হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামের একজন নিহত হন, আশপাশের আটটি হিন্দুপাড়ায় অন্তত ৩০০ বাড়িঘর, মন্দির ও দেবমূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছিল। অনেকেরই ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। এখানেও স্ট্যাটাস দেওয়া অ্যাকাউন্টটা রহস্যে ঘেরা। কারণ, এই স্ট্যাটাস দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত রসরাজ পেশায় একজন জেলে। তিনি ফেসবুক চালাতে জানেন না; কাকে বলে পাসওয়ার্ড, কোনো ধারণাই তাঁর নেই। যে পোস্টকে ঘিরে এত ঘটনা, সেটির বিষয়েও পরে আর কিছু জানা যায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো আতঙ্ক বুকে নিয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

নাসিরনগরে হামলার ঠিক এক বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ঠিক একই কায়দায় হামলা চালানো হয়, মারা যান একজন। পরের ঘটনাটি গত বছরের। ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের একজন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন, তার দোহাই দিয়ে ২০২০ সালে কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা এবং ভাঙচুর করা হয়। এরপর এই ২০২১ সালে ঘটল সুনামগঞ্জের ঘটনা। এর বাইরে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এলাকাগুলোতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর এ ধরনের হামলার পর কত মানুষ এলাকা ছাড়ে, দেশ ছাড়ে, তার কোনো পরিসংখ্যান কোথাও প্রকাশিত হয় না।

পাঠক লক্ষ করবেন, প্রতিটি হামলার প্রেক্ষাপট একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যার আইডি পর্যন্ত ভুয়া। আর প্রতিটি হামলার পরপরই এলাকা থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চলে যায়। কখনো এলাকা ছাড়ে, কখনোবা ছাড়ে দেশ। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় সরকার যখন ঘোষণা করল, যাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আরও ‘ভালো’ ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে, তখন ভুক্তভোগীদের অনেকেই বলেছেন, নতুন ঘরবাড়ি তাঁরা চান না​। এটি তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, তাঁদের যে ভয়ের স্মৃতি, তা মুছে দিতে পারবে না।

হামলার আগে এলাকায় সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে সুসম্পর্ক থাকে, সেটি আর ফিরে আসে না। নষ্ট হয়ে যায় একে অপরের প্রতি আস্থা, জায়গাটা তাদের জন্য আর স্বস্তিকর এবং নিরাপদ থাকে না। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাই অনেকে চুপি চুপি এলাকা বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, কারা, কী জন্য এই হামলাগুলো করেন বা করান? এর পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকে? আরও কিছু বিষয় যদি আমরা আমলে নিই, তাহলে দেখতে পাব যে প্রতিটি হামলাতেই আলাদা করে নারীর প্রতি সহিংসতা গুরুত্ব পেয়েছে। আর এটি যখন হয়, আক্রান্ত পরিবারগুলো তখন আরও ভীত হয়ে পড়ে। তখনই তারা দেশছাড়া কিংবা এলাকাছাড়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এগুলো ঝোঁকের মাথায় নিছক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। এর পেছনে থাকে মূলত ভূমি দখলের রাজনীতি। হামলাকারীরাও ‘সাধারণ’ কোনো মানুষ না, ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে এদের মূল লক্ষ্য থাকে ভূমি দখল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পেয়েছি, রাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকায় হামলাকারীরা প্রশ্রয় পায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে উৎসাহিত করে, যে পর্যন্ত না তারা ভূমি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় সেই হামলাকারীদের কাছেই নামমাত্র মূল্যে জমিটি বেঁচে দেয় তারা। ক্ষমতার ক্রমাগত চাপে এবং তাপে তত দিনে তারা জেনে যায়, বাপ-দাদার ভিটাবাড়িতে তারা আর থাকতে পারবে না।

সাম্প্রদায়িক হামলার ধারাবাহিকতার পরও মৌখিক হুঁশিয়ারি ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। কারণ, বাংলাদেশের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে যখন-তখন ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারাও তাই নিশ্চুপ থেকে এই হামলাকারীদের রাজনৈতিক আশকারা দেয়।

তাই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ কিংবা ‘রাষ্ট্র সবার’—এ ধরনের কথাবার্তা যে শুধুই বুলি, তা প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো আমাদের আঙুল উঁচিয়েই দেখিয়ে দেয়। তাই ভুতুড়ে স্ট্যাটাসের উৎস খুঁজে বেড়ানোর বদলে হামলাকারীদের পরিচয় শনাক্তে মনোযোগী হোন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, মূল জায়গা ফেসবুক স্ট্যাটাস নয়, ভূমি দখল। সেটা ঠেকানোই সবচেয়ে জরুরি।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]