ফ্রান্সে গণতন্ত্রের আপাত-বিজয়

তবে ফরাসি জনগণ ভুল করেননি, ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দর্শনসহ নানা সংস্কারের ধারক ফ্রান্স তার পুরোনো ঐতিহ্যকে বিকিয়ে দিয়ে সস্তা স্লোগানসর্বস্ব কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের মারি লো পেনকে সর্বোচ্চ ভোটে জয়যুক্ত করেননি। ফ্রান্সে
অব্যাহত সন্ত্রাসী হামলা ও ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর নেতাদের অনৈতিক আর্থিক অনিয়ম এবং দেশ চালানোর অযোগ্যতার মুখে ফরাসি ভোটাররা প্রথম পর্বের ভোটে বেছে নিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ সাবেক সোশ্যালিস্ট দলের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী দলহীন এন ম্যারশে আন্দোলনের নেতা ইমানুয়েল ম্যাখঁকে। তবে ৭ মে দ্বিতীয় পর্বের ভোটেও থাকছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী মারি লো পেন।

ফ্রান্সে ১৯৬৫ সাল থেকে সরাসরি জনগণের ভোটে দুই পর্বের নির্বাচন প্রথা চালু হয়। এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন মোট ১১ জন। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা লো পেন এবং দলনিরপেক্ষ মধ্যপন্থী সাবেক অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাখেঁর মধ্যে। ২৩ এপ্রিল প্রথম পর্বের ভোটে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম অবস্থানে আছেন এন ম্যারশে আন্দোলনের নেতা ইমানুয়েল ম্যাখঁ, ২১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন মারি লো পেন, ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছেন রিপাবলিক দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ফিলোঁ, ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন বাম দলের প্রার্থী জ্যঁ-লুক মিলনশঁ, আর ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে শেষ পাঁচে আছেন ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বেনিউট হামন।

মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোতে যখন অনিশ্চয়তা, ব্যক্তিত্বের সংকট চলছে, তখন অর্থনৈতিক স্থবিরতা, অনিয়ম, কেলেঙ্কারির অভিযোগ, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং বারবার সন্ত্রাসী হামলার মুখে সামনে চলে আসেন ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা লো পেন। অন্যদিকে ছিলেন দলনিরপেক্ষ মধ্যপন্থী ৩৯ বছর বয়সী সাবেক অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী ইমানুয়েল ম্যাখঁ। ইমানুয়েল ম্যাখেঁর এন ম্যারশে বা এগিয়ে যাও আন্দোলনে সমর্থন জোগাচ্ছেন সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এবং সেলিব্রিটি ও তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা। রিপাবলিক দলের প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ফিলোঁ নানা অনিয়ম আর সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগে নির্বাচনে ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না। আর ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বেনিউট হামনের দলের মধ্যে বিভিন্ন ধারার অনৈক্যের কারণে নির্বাচনে ভালো করার সুযোগ ছিল না। তবে বাম দলের জ্যঁ-লুক মিলনশঁ নির্বাচনে খারাপ করেননি।

নির্বাচনে অন্যতম জনপ্রিয় ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা লো পেন নির্বাচনী ইশতেহারে শক্ত হাতে সন্ত্রাসী ও অভিবাসী আইন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য গণভোটের আয়োজন, ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা, সেঙ্গেন সীমান্ত চুক্তি বা ভিসা প্রথা বাতিল, সাপ্তাহিক ৩৫ ঘণ্টা কাজের বদলে পুনরায় ৩৯ ঘণ্টা সময়সূচি ও সমকামীদের ক্ষেত্রে নতুন আইন এবং পারমাণবিক জ্বালানি চালু করার কথা বলেছিলেন।

অপর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইমানুয়েল ম্যাখঁ নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সমস্যাবহুল খাতগুলোতে অধিক সরকারি বিনিয়োগ, অধিক চাকরির ব্যবস্থা, সন্ত্রাস দমনের জন্য অধিক পুলিশ নিয়োগ, পেনশনের নতুন বয়সসীমা নির্ধারণ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন।

বিগত বছরগুলোতে ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট দল আর রিপাবলিক দলের বাইরে ফরাসি জনগণ রাজনীতির নতুন অবয়ব খুঁজছিল। আর ফ্রান্সের জন্য নতুন রাজনীতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১৬ সালে এন ম্যারশে আন্দোলন বা এগিয়ে যাও গঠন করেন সোশ্যালিস্ট দলের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ইমানুয়েল ম্যাখঁ। ফ্রান্সের রাজনীতিতে তিনি তাঁর এই জোটকে মধ্য বামপন্থার বিকল্প রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। যদিও দলনিরপেক্ষ, তবু তাঁদের রাজনীতিতে ফ্রান্সের জনগণ আশার আলো দেখেছেন।

মারি লো পেন অভিবাসী, সন্ত্রাসী হামলা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী প্রচারণা দিয়ে নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেও বা ৭ মে চূড়ান্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও তিনি যে রকম আরও বেশি ভোট পাবেন বলে আশা করেছিলেন, তা পাননি।

এখন ৭ মে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে প্রথম পর্বের প্রথম ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী ইমানুয়েল ম্যাখঁ এবং মারি লো পেনের মধ্যে। দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনটি হবে মূলত মধ্য রক্ষণশীল বাম রাজনীতির সমর্থক আর কট্টর রক্ষণশীল সমর্থকদের মধ্যে। অতীত ও সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যায়, সেই সময় গণতন্ত্রের সপক্ষের ফরাসি জনগণ ইমানুয়েল ম্যাখঁকেই আগামী পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেবেন।

ফ্রান্সের প্রধান দুই সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক দলের বা বাম দলের যে রাজনৈতিক কাঠামো ফ্রান্সজুড়ে ছড়িয়ে আছে, এক বছর আগে গঠিত এন ম্যারশে জোটের তা নেই। আগামী ১১ ও ১৮ জুন যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক দলের নির্বাচিত সাংসদদের সহযোগিতা দেশ চালাতে প্রয়োজন হবে। ৭ মে চূড়ান্ত নির্বাচন থেকে বাদ পড়া সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক দলের দুই প্রার্থী বেনিউট হামন ও ফ্রাঁসোয়া ফিলোঁ ইতিমধ্যেই কট্টরবাদী মারি লো পেনকে ঠেকাতে ইমানুয়েল ম্যাখঁকেই সমর্থন জানিয়েছেন। তবে বাম দলের প্রার্থী জ্যঁ-লুক মিলনশঁ দ্বিতীয় পর্বে কাকে সমর্থন করবেন, তা বলেননি। আদর্শগতভাবে ভিন্নমতাবলম্বী হলেও তাঁরা উভয়ই ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী।

আমেরিকায় রক্ষণশীল ট্রাম্পের বিজয়, ব্রিটিশদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্সসহ আরও কিছু ইউরোপীয় দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের মাঝে বিপুল উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে নেদারল্যান্ডসে তাঁদের পারজয় হলো। সম্ভবত, ফ্রান্সেও তাঁদের একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। এতে কট্টরপন্থীদের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়বে বলেই মনে হয়। তাই ফ্রান্সের প্রথম পর্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফ্রান্সের তথা ইউরোপীয় গণতন্ত্রেরই আপাত-বিজয়।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]