‘ফ্রি লাঞ্চ’ বলে কিছু নেই

শিরোনামটির উদ্ভব হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে মধ্য উনিশ শতকে পানশালায় গ্রাহকদের বিনা মূল্যে দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হতো। তবে বিনা মূল্যের খাবার পাওয়ার জন্য ন্যূনতম একটি বিয়ার অথবা অন্য মদজাতীয় পানীয় কিনতে হতো। সরবরাহকৃত খাবারের মধ্যে ছিল লবণাক্ত হ্যাম, চিজ ও ক্র্যাকার। লবণাক্ত এসব খাবার গলাধঃকরণের জন্য গ্রাহকদের অনেকে বিয়ার কিনে পান করত। আর চতুর দোকানমালিকেরা মদ্যজাত পানীয় বিক্রির আয় থেকে বিনা মূল্যের খাবারের ব্যয় পুষিয়ে নিত। পরে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান একই শিরোনামের একটি বইও লেখেন। ‘ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু নেই’ ধারণার মোদ্দাকথা হলো, কিছু পেতে হলে কিছু মূল্য দিতেই হবে। আপাতদৃষ্টে যা ফ্রি, তার জন্য অন্য কাউকে আগে–পরে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তা অর্থনৈতিক সদাচার বা অনাচার, যা–ই হোক না কেন।

এক যুগ ধরে সংঘটিত অর্থনৈতিক অনাচারের তালিকাটি দীর্ঘ। অনেকে দোহাই দিচ্ছিলেন, উন্নয়ন করতে গেলে এমন এক–আধটু হবেই। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে অতীতের অপকর্ম থেকে রেহাই নেই, এর দায় নিতেই হবে (চিকেন্স হ্যাভ কাম হোম টু রোস্ট)। যদিও সবার জানা, তবু আবার মোটাদাগের কয়েকটি অপকর্মের উল্লেখ করছি।

খেলাপি ঋণ ও মুদ্রা পাচার

মাত্র ১২ বছরেই খেলাপি ঋণ ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ কোটি টাকার ওপরে। এর একটা বিরাট অংশই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। বাংলাদেশ থেকে টাকা বেরিয়ে গেছে দুভাবে। একটি উপায় হচ্ছে পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার। আরেকটি হচ্ছে পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। এ অর্থ দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল করা যেত। এ ছাড়া সরকার বঞ্চিত হয়েছে আমদানি শুল্ক ও আয়কর থেকে।

উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সাম্প্রতিক এক সভায় মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা এবং সেই সঙ্গে মেয়াদ বেড়েছে সাড়ে তিন বছর। মাতারবাড়ী কোনো ব্যতিক্রম নয়। পদ্মা সেতুসহ সব প্রকল্পেই অভাবনীয় ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করা। এ ধরনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির ফলে বাস্তবায়িত প্রকল্প জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি না করে তা হ্রাস করে।

শেয়ারবাজার কারসাজি

২০১০-১১ সালে শেয়ারবাজারে ধস নামে। এ সময় কুশীলবেরা পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালেও শেয়ারবাজারে এ ধরনের ধস নামে। তখনো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। বর্তমানেও একই ধারা অব্যাহত আছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনেই উৎপাদনহীন ও কারখানা বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। কিন্তু ডিএসই কিছুই করছে না। ডিএসইর ব্রোকাররা কারসাজি করছে; ডিএসইর সামনেই বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে!’ এর ফলে বিনিয়োগকারীরাই কেবল সর্বস্বান্ত হচ্ছেন না, তাঁরা বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে

অবশেষে এসব আর্থিক অনাচারের দায় মেটানোর সময় এসেছে। সমস্যা হলো এখন তা করতে গিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। যারা অপকর্ম করল, তারা থাকল ধরাছোঁয়ার বাইরে—কানাডা, আমেরিকা বা ইউরোপে। দায় মেটানোর ভার পড়েছে নিরীহ জনগণের ওপর। দেখা যাক, কীভাবে উল্লিখিত আর্থিক অপকর্মের দায় মেটানো হচ্ছে।

বিগত বছরগুলোর আর্থিক অনাচারের দায় মেটানোর সময় এসেছে সরকারের এখন। সমস্যা হলো এখন তা করতে গিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। যারা অপকর্ম করল, তারা থাকল ধরাছোঁয়ার বাইরে—কানাডা, আমেরিকা বা ইউরোপে। দায় মেটানোর ভার পড়েছে নিরীহ জনগণের ওপর।

সঞ্চয়পত্রের সুদ হ্রাস

সরকারের বল্গাহীন অপব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হয়েছে, যাতে সরকারি ঋণের ব্যয় কমে। আর্থিক নিষ্পেষণ চলছে নিম্ন আয়ের অবসরভোগীদের ওপর, যাঁরা নিতান্তই সহায়হীন।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি

সম্প্রতি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। যুক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিপিসির লোকসান ও প্রতিবেশী ভারতে চোরাচালানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো কোনো যুক্তি নয়। আসল কারণ হলো সরকারের অর্থনৈতিক অনাচার চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থসংস্থান নেই। দুঃখের বিষয়, এ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানির প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে। তেলের দাম বাড়ায় কৃষক থেকে শুরু করে নাগরিক মধ্যবিত্তরা ভোগান্তির শিকার হবেন বেশি। মূল্যস্ফীতি নিশ্চিতভাবেই বাড়বে।

যা করা সমীচীন হতো

আমি এটা বলছি না যে জ্বালানি তেলের দাম সব সময় স্থির থাকবে। জ্বালানি তেলের দাম প্রতিনিয়ত বিশ্ববাজারে ওঠানামা করে। ম্যাক্রোট্রেন্ডসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১, ২০২০, ও ২০১৯ সালে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় মূল্য ছিল যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭৪, ৩৯ দশমিক ৬৮, ও ৫৬ দশমিক ৯৯ মার্কিন ডলার। তাই প্রশ্ন ওঠে, বিশ্ববাজারে বর্তমানে তেলের গড় মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দাম বাড়ানো হলেও ২০২০ সালে যখন গড় মূল্য অর্ধেকের কাছাকাছি ছিল, তখন দাম কমানো হয়নি কেন? আর সে সময় বিপিসি আহৃত লাভই–বা গেল কোথায়?

এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৯১ সালে, তখনো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন হয়নি। অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় মিলে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করত। আমি তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজ করি। জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ কোনোভাবেই আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়; যদিও এ মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুল্ক ও করাদির একটা ভূমিকা আছে। ড. আকবর আলি খান সবে এনবিআরের চেয়ারম্যান থেকে অর্থ বিভাগের সচিব হয়েছেন। তিনি একটা সভা ডেকেছিলেন, যাতে আমি এনবিআরের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিই। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আমি এ ব্যাপারে একটি পরিস্থিতিপত্র তৈরি করব। বিপিসির একজন মহাব্যবস্থাপক আমাকে আমদানি মূল্য, পরিবহন ব্যয় ও অন্যান্য তথ্য এবং অর্থ বিভাগ থেকে সম্ভাব্য ভর্তুকির তথ্য দিয়ে সহায়তা করবেন। সাবেক বসের অনুরোধ ও বিষয়টি জানার আগ্রহের কারণে আমি রাজি হই।

আমি মূল্যের তিনটি বিভিন্ন প্রক্ষেপণ পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করি, এর মধ্যে একটি গৃহীত হয়। সে সময় বাড়তি হিসেবে, পরিস্থিতিপত্রে লোটাস ১২৩-তে আমি ভবিষ্যতে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের একটি মডেল তৈরি করি। মডেলটিতে গড় আমদানি মূল্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যয়, শুল্ক করাদি, ভর্তুকি ইত্যাদি উপাত্ত দিলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা যেত। আমি প্রস্তাব করি, এটি ব্যবহার করে বছরে বছরে কয়েকবার জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হোক। সভায় উপস্থিত জ্বালানিসচিব সৈয়দ আবদুস সামাদসহ সবাই আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেও প্রস্তাবটি এখনো কার্যকর হয়নি। অথচ প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশেই এ ধরনের ফর্মুলা অনুসরণ করে একাধিকবার জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

শেয়ারবাজার চাঙা করতে হলে গত দুই দফা শেয়ারবাজার ধস কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় এনে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া কমিশনের নেতৃত্বে দলবাজদের বাদ দিয়ে প্রকৃত মেরুদণ্ডী পেশাদারদের আনতে হবে। আমানত ও ঋণের সুদের হার নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। সুদের হার কমানোর জন্য মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় অবসরভোগী ও মধ্যবিত্ত এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিশেষ হারে বিনিয়োগের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।

অর্থনৈতিক অনাচার ও সরকারি ব্যয়ের ওপর হ্রাস টেনে ধরতে হবে। ঋণখেলাপিদের দেশে ফিরিয়ে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। জনগণ আর্থিক অনাচারের সুবিধাভোগীদের ফ্রি লাঞ্চের ব্যয় মেটাতে পর্যুদস্ত। এর আশু অবসান হওয়া প্রয়োজন।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ