ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের ভিডিও, নাগরিক আন্দোলন ও পুলিৎজার জয়ের কাহিনি

জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের সেই দৃশ্য।
ফাইল ছবি

ডারনেলা ফ্রেজার। সদ্য পুরস্কৃত কিশোরী। জিতে নিয়েছে সাংবাদিকতা বিষয়ে নোবেলের কাছাকাছি মর্যাদাময় স্বীকৃতি বিবেচিত ‘পুলিৎজার’ পুরস্কার। যদিও পুরস্কারটি মূলত ‘সাহিত্য’জগতের জন্য, সাংবাদিকতাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। নাগরিক সাংবাদিকতাকে এখনো পেশাদার সাংবাদিকতার সংজ্ঞাধীন করা যায়নি। পুলিৎজার কর্তৃপক্ষও ব্যতিক্রম নয়। সে কারণেই সম্ভবত ডারনেলা ফ্রেজারকে পুরস্কারটি দেওয়া হয় ‘বিশেষ পুলিৎজার’ হিসেবে।

গত বছর ডারনেলা ফ্রেজারের মুঠোফোনেই ধারণ করা হয়েছিল পুলিশের দ্বারা জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। তারপরের ঘটনা সবারই জানা। দুনিয়াময় বর্ণবাদ প্রসঙ্গটি আবারও আলোচনায় এল। গত বছরের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনটি বর্ণবাদ প্রসঙ্গেই আটকে থাকল না; নতুন নতুন আলোচনার জন্মও দিল। কথা উঠল ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সামাজিক সমতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, অলিখিত বঞ্চনা ইত্যাদি নিয়ে।

আন্দোলনটিও শুধু মার্কিন মুলুকেই থেমে থাকল না; মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাংবাদিকতার ক্লাসেও ফিরে এল আদি নাগরিক সাংবাদিকতার ইতিহাস। ১৯৯১ সাল। তখনো সেলফোন, ক্যামেরাফোন জনতার হাতে হাতে আসেনি। কালো মানুষ রডনি কিংকে উন্মুক্ত রাস্তায় একদল হিংস্র সাদা পুলিশ নৃশংসভাবে পিটিয়েছিল। জর্জ হলিডে নামের অন্য একজন পথচারী তার হাতের ক্যামকর্ডারে ঘটনাটি রেকর্ড করে নেন। পরে সেটিই কালো মানুষের প্রতি পুলিশি নৃশংসতার দালিলিক প্রমাণে পরিণত হয়।

নাগরিক সাংবাদিকতার শক্তিমত্তা বিশ্ববাসীর গোচরে আসতে শুরু করে তিউনিসিয়ার রাস্তায় আবদুল আজিজ বুয়াজিজির নিজ গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। বুয়াজিজির নিজ গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া আরবসমাজের আমজনতার গায়েই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আগুন ধরিয়ে দেওয়াই ছিল বুয়াজিজির ভাষা। একজন নাগরিক তাৎক্ষণিকভাবেই ঘটনাটি ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করলেন এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন। সেটি হয়ে গেল নাগরিক সাংবাদিকতার ভাষা। সমাজকে দ্রুত পঠনের ভাষা, সে ভাষা লাখ লাখ ভাষাহীন মানুষকে প্রতিবাদের ভাষা উপহার দিল। যারা ছিল মৌন, মূক ও বধির, তারা দলে দলে নেমে এল রাস্তায়। ‘আরব বসন্ত’ হলো। তিউনিসিয়ার পর একে একে স্বৈরাচারের পতন ঘটল মিসর, লিবিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে। গণ-আন্দোলন দুর্নিবার হলো বাহরাইন, সিরিয়া, আলজেরিয়া, জর্ডান, মরক্কো, কুয়েত, সুদান ও মালিতে।

‘আরব বসন্ত’ আসলে কী ছিল? সেটি ছিল নাগরিক ভাষা। সেবার বিশ্বের প্রথাগত সব সংবাদ প্রতিষ্ঠান আরব বসন্ত কভার করতে নেমে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমকে ছাড়িয়ে বহুগুণ বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সামাজিক মাধ্যমের নাগরিক সাংবাদিকতা। একই ঘটনা ঘটল জর্জ ফ্লয়েডের বেলায়ও। সারা বিশ্বে কোটি কোটি চোখ উন্মুখ হয়ে থাকত সামাজিক মাধ্যমে। অপেক্ষা কখন কোন কোন ফোন-ক্যামেরা ক্লিপগুলো ভিড়ভাট্টার ভেতর থেকে এমন সব ভিডিও ও ছবি তুলে আনবে, যা রেকর্ড করতে পারা প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকের পক্ষে কঠিন।

সমাজের উঁচুতলার সুবিধাপ্রাপ্তদের চেয়ে নিম্নবর্গের মানুষই শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়-অনাচার ও অনিয়মের বলি হন বেশি। তাঁদের প্রতি গণমাধ্যমের নজরও পড়ে খানিকটা পরেই। নিম্নবর্গ ও প্রান্তজন-ব্রাত্যজন পাঠের তাত্ত্বিকগণ, যাঁদের ইংরেজিতে সাবঅলটার্ন থিওরিস্ট বলা হয়, তাঁদের প্রথম প্রশ্নই থাকে নিম্নবর্গের মানুষকে কথা বলতে পারার অধিকারটি দেওয়া আছে তো? তাঁর বলতে পারার ক্ষমতাটি কেড়ে নেওয়া আছে কি না, পর্যায়ক্রমের সে প্রশ্নও আসে। শিক্ষিত বুয়াজিজি ডিগ্রিধারী হয়েও চাকরি-বাকরি পেলেন না। কারণ, তিনি ক্ষমতাহীন। মামা-চাচা নেই, টাকার জোর নেই। স্বৈরাচারী সরকার তাঁর কথা শোনে না। তিনি ভাষাহীন। তাঁর ভাষার অধিকার ও বলার ক্ষমতা—দুটোই কেড়ে নেওয়া। নিরুপায় মানুষটি যখন নিজ উদ্যোগে জীবিকার ব্যবস্থা করলেন, রাস্তায় ভ্যান চালিয়ে ফল বিক্রি করতে শুরু করলেন। শুরু হলো পুলিশি জোরজবরদস্তি, ক্ষমতা দেখানো ও চাঁদাবাজি। ফলাফল, তাঁর নতুন ভাষা প্রয়োগ।

অ্যালিসা রিচার্ডসন সাংবাদিকতা বিষয়ের একজন নবীন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক। পড়ান ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’। গত বছর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছে তাঁর বই ‘কৃষ্ণাঙ্গ যখন সাক্ষী: আফ্রিকান-আমেরিকান, স্মার্টফোন এবং নব্য প্রতিবাদী সাংবাদিকতা’। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের বহু আগেই, ২০১৪-১৫ সালে দিকে পিএইচডি গবেষণার জন্য তিনি ‘কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মোবাইল সাংবাদিকতা’কে বিষয় হিসেবে বেছে নেন। পরীক্ষামূলকভাবে মোবাইল সাংবাদিকতা শুরুও করেন। উদ্দেশ্য ভাষাহীন, সুবিধাবঞ্চিত ও ব্রাত্যদের জন্য সাংবাদিকতা। লক্ষ্য সামাজিক ন্যায়বিচার, নারী-পুরুষের ও ধর্ম-বর্ণের বৈষম্য, অন্যায় পুলিশি আচরণ ইত্যাদি অসম্পাদিত খোলা চোখে দেখা।

লাইভ স্ট্রিমিং নাগরিক সাংবাদিকতার অন্যতম কৌশল। অ্যালিসার পরীক্ষণ দলটি ছিল আকারে নিতান্তই ছোট। মাত্র কয়েকজন। কিন্তু তাঁরাই তুলে আনতে শুরু করলেন সমাজের নানা পরতে অন্যায়-অসংগতির চিত্র। বিষয়টি ছিল অনেকটাই অভাবনীয়। দেখাদেখি অন্য আরও অনেকেও নাগরিক সাংবাদিকতায় নেমে পড়ল। ডায়মন্ড রেনল্ড লাইভ স্ট্রিমিং করে বসলেন ফিল্যান্ডো ক্যাস্টিলের হত্যাদৃশ্য। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই মিনেসোটায় পুলিশ পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে পরপর সাতটি গুলি করে ক্যাস্টিলেকে হত্যা করে। হত্যার সময় ক্যাস্টিলের সঙ্গে ছিল তাঁর চার বছরের কন্যাসন্তান এবং বান্ধবী। রেনল্ডের নাগরিক সাংবাদিকতাটি না হলে হত্যাকারী পুলিশ হয়তো শক্ত কোনো বানোয়াট অজুহাতের বরাতে বেঁচে যেত। কিন্তু আদালত রেনল্ডের প্রামাণ্য ভিডিওর ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন যে ফিল্যান্ডো ক্যাস্টিল পুলিশের প্রতি মোটেই হুমকি ছিলেন না। তিনি গাড়িতে রাখা তাঁর লাইসেন্সকৃত বন্দুকটিও নিতে যাচ্ছিল না। তাঁর হত্যাকাণ্ড পুলিশের বর্ণবাদপ্রসূত।

এ লেখার স্বল্প পরিসরে উদাহরণ টানা সম্ভব নয়। তবে মোটাদাগে বলা চলে, আরব বসন্তের সময় থেকে অদ্যাবধি প্রায় এক দশক বিশ্বজুড়ে নাগরিক সাংবাদিকতার অসংখ্য উল্লেখযোগ্য সুফল পেয়েছে আমনাগরিক। কোথাও ন্যায়বিচার মিলেছে, কোথাও কোথাও অন্যায়-অপকর্ম-দুর্নীতির রাশ টানা গেছে। ইন্টারনেট এবং মুঠোফোনের বৈপ্লবিক অগ্রগতি নাগরিক সাংবাদিকতারও অগ্রগতি ঘটিয়েছে।

প্রথাগত সাংবাদিকের জন্য অনেক স্থান অগম্য। অনেক ঘটনা সংঘটনকালে সংবাদকর্মীর জন্য তাৎক্ষণিক সাড়াদান সব সময় সম্ভব হওয়ার কথা নয়। অংশগ্রহণের বেলায়ও তাঁদের প্রস্তুতি ও নিয়মকানুনের প্রয়োজন হয়। এথিকস বা নৈতিকতা মানতে তাঁরা বাধ্য থাকেন। সঙ্গে একাধিক সহকর্মীর প্রয়োজন হয়। সংবাদ গ্রহণ, ব্যবহার এবং প্রচারের আগে সম্পাদনা থাকে। উচ্চতর সম্পাদনায় থাকা দায়িত্বশীলদের অনুমোদনের অপেক্ষা থাকে। তার বাইরেও থাকে নিয়ম-শৃঙ্খলা, দায়িত্বশীলতা ও দায়বোধের বাঁধন। বাংলাদেশের বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনাটি মনে করা যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকেরা হয়তো ভিডিওটিই দৃশ্যবন্দী করতে সক্ষম হতেন না। তাঁদের ক্যামেরা ক্রুসহ দৃশ্যমান উপস্থিতিতে হত্যাকাণ্ডটিই হয়তো সংঘটিত হতো না।

পক্ষান্তরে, নাগরিক সাংবাদিকতা ঘটনা সংঘটনের তাৎক্ষণিক শব্দ ও চিত্র অবিকল এবং অবিকৃত উপস্থাপন করতে পারে। কারণ, নাগরিক সাংবাদিকের কাজের ক্ষেত্রটি আগে থেকে নির্ধারিত নয়। নাগরিক স্বপ্রণোদিত। ঘটনাটি তাঁর বিচারে সংবাদ হওয়ার মতো। তিনি মনে করেছেন, ঘটনাটিকে তথ্যবদ্ধ করা নাগরিক দায়িত্বের অংশ। কাজটি খুবই প্রয়োজনীয়। এই বিচারবোধ একজন প্রথাগত পেশাদার সম্পাদকের মতো না হতে পারে বটে, কিন্তু তাঁর সম্পাদনামনস্কতাকেও উপেক্ষা করার জো নেই। তবে স্বীকার করতেই হয় যে নাগরিক সাংবাদিকতা এখনো নবীন এবং নানা কারণে এর ভূমিকা এখনো অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জনমানসের আপত্তির বিষয়টিও উঠে এসেছে। বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমেই ভিডিওচিত্রধারীরাও ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন। যেমন তাঁরা বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর চেষ্টায় কেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন না, কীভাবেই-বা ভিডিওচিত্র ধারণ করার মানসিক সুস্থিতি বজায় রাখলেন ইত্যাদি।

রোডস বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউ মিডিয়া ল্যাবের অধ্যাপক-গবেষক ভিনসেন্ট ম্যারও মনে করেন, নাগরিক সাংবাদিকতা তিনটি ‘ই’র [ইংরেজি বর্ণ] কারণে সাংবাদিকতার জন্য মহাবিপর্যয়কর। তিনটি ‘ই’ হচ্ছে এথিকস, ইকোনমিকস ও এপিস্টেমোলজি, অর্থাৎ নৈতিকতা, অর্থনীতি ও জ্ঞানতত্ত্ব। নৈতিকতার দেখভালের কেউ নেই, অর্থব্যবস্থাপনা নেই এবং জ্ঞানজাগতিক বিচারে কার্যক্রমগুলোকে ‘সাংবাদিকতা’র স্বীকৃতি দেওয়া কঠিন। নারীবাদী বিদ্বানদের একাংশও মনে করেন, নাগরিক সাংবাদিকতার ভায়োলেন্স দেখানোর বদভ্যাস আছে। নারীরাই ভায়োলেন্সের বড় শিকার। নারীদের প্রতি ভায়োলেন্স চলার দৃশ্য বাজারজাতকরণের চেষ্টার কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা দেখা দর্শকদের গা-সহা হয়ে যেতে পারে। অথবা স্বাভাবিক ভাবা শুরু হতে পারে।

আপত্তি-অনাপত্তির মধ্যেও নাগরিক সাংবাদিকতা মূলধারার গণমাধ্যমের সমকক্ষ বা আরও বেশি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে। ভিনসেন্ট ম্যারের মতো কয়েকজনের সমালোচনার বাইরে গণমাধ্যম-পণ্ডিতদের বেশির ভাগই মনে করছেন, নাগরিক সাংবাদিকতার ইতিবাচক ও দরকারি সাংবাদিকতা হয়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত পিউ রিসার্চ সেন্টারের অতি সাম্প্রতিক গবেষণার উল্লেখ আবশ্যক। গবেষণাটি দেখিয়েছে যে নামকরা সাংবাদিকদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই তাঁদের সংবাদ নির্মাণে নাগরিক সাংবাদিকদের তৈরি করা প্রতিবেদনগুলোর সহায়তা নেন। এ তথ্য থেকেই স্পষ্ট, ডারনেলা ফ্রেজারের পুলিৎজার প্রাপ্তিকে নাগরিক সাংবাদিকতারই বিজয় বিবেচনা করা যেতে পারে।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়