বঁধু, মিছে রাগ! করোনা!

মাসখানেক আগে এমন হলো, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নিজের নিকটাত্মীয়র জন্য হাসপাতালের বেড খুঁজছিলাম, পাচ্ছিলাম না। ডাক্তার ভাইবোন-ভায়রাদের বলি, তাঁদের একজন বললেন, ‘আরে, আমি হাসপাতালের ব্যবস্থাপকের রুমে গেছি বেডের জন্য তদবির করতে, তিনি দেখি ফোনে আরেক হাসপাতালে ফোন করছেন, ভাই একটা বেড থাকলে দেন, খুবই আর্জেন্ট।’

এখন শুনি, হাসপাতালে কোভিড ইউনিটের বেড খালি আছে। রোগী কমে যাচ্ছে দ্রুত। শুনে মনটা ভালো হলো। শঙ্কাও জেগে উঠল। এই ভালো কত ভালো, কত দিনের জন্য ভালো।

তো আপাতত যে করোনা রোগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তার কারণ কী? সরকার ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলবেন, লকডাউন। আমরা এপ্রিলের শুরু থেকে প্রথমে ঢিলেঢালা লকডাউন, তারপর কঠোর লকডাউন, তারপর কসম লকডাউন করতে থাকায় এপ্রিলের শেষে এবং মের শুরুতে এর সুফল দেখতে পেলাম।

তবে আমি যখন আমার রসিকতম বন্ধু শাহেদকে বললাম, ‘শাহেদ, হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নাকি বেড খালি পড়ে আছে?’ শাহেদ বললেন, ‘হ্যাঁ, হাসপাতালে ভিড় এখন কম, সবাই মার্কেটে চলে গেছে, মার্কেটে ভিড় বেড়ে গেছে।’

লকডাউনের কারণে বাসা থেকে বের হই না। একদিন বের হয়ে দেখি, যানজট! তার মানে কি এই যে আমি বাদে সবাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন? আমার নিজের ধারণা, সরকারের এখনকার বুদ্ধিটা ভালো হয়েছে। বলছে লকডাউন, কিন্তু দোকানপাট খোলা, যাও কিন্তু যেয়ো না, যেয়ো না, কিন্তু যাও। আর আন্তজেলা যানবাহন বন্ধ। যার যার এলাকায় থাকো। ঢাকার করোনাভাইরাস বহন করে গ্রামে যেয়ো না।

করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, মাস্ক পরার দরকার নেই। তবে আপনার যদি সর্দি-কাশি-হাঁচি থাকে, আপনি মাস্ক পরবেন। তখন হংকং, চেক রিপাবলিক নানা দেশ থেকে প্রচারণা আসত, আমাদের এখানে করোনার প্রকোপ কম, কারণ আমরা সব সময় মাস্ক পরে থাকি। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলল, মাস্ক পরুন। এখন বলা হচ্ছে, দুইটা করে মাস্ক পরুন।

এ বিষয়ে আমার প্লে-গ্রুপে পড়া নাতনি সম্প্রতি ইউটিউবে হইচই ফেলে দিয়েছে। সে সবাইকে বলেছে, হাত ধুতে হবে, ঘরে থাকতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, বাইরে যাওয়া যাবে না। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, এটা কি তুমি নিজে থেকে বলেছ, নাকি কেউ শিখিয়ে দিয়েছে? সে বলল, ‘নিজে থেকে বলেছি।’

‘বাহ্‌। খুব ভালো। কেন মনে হলো এ রকম একটা ভিডিও করে অনলাইনে দিতে হবে?’

বাচ্চা বলল, ‘আমি লিপিত্তিক দেই, কেউ দেখতে পায় না। মাস্ক পরে থাকতে হয়।’

এই সমস্যা আমারও হয়েছে। সামনের দাঁতগুলো বড় হওয়ায় আমার মুখ হাসি-হাসি। আমি যখন বুঝতে পারলাম, হাসিমুখ সবাই পছন্দ করে, তখন সামনে কাউকে পেলেই হাসি। আমার এই হাসি দিয়ে আমি ব্যাংকের লাইনের পেছন থেকে সামনে যাই, ফ্লাইটে ইকোনমি ক্লাসের টিকিট কেটে আপগ্রেডেড হয়ে বিজনেস ক্লাস পাই, রেস্টুরেন্টে খেতে বসে ডেজার্ট পাই ফাউ। করোনার মধ্যে বের হয়ে দেখি, আমার ম্যাজিক ফুরিয়ে গেছে। কেউ একটু সালামও দেয় না। বেশ খানিকটা সময় লেগেছে এ কথা বুঝতে যে আমার মুখের ‘লিপিত্তিক হাসি’টাই তো কেউ দেখছে না, মুখ যে মুখোশে ঢাকা।

আমিও তাই চাই যে পৃথিবী থেকে করোনা দূর হয়ে যাক, যাতে মুখোশ না পরেই আমি বাইরে যেতে পারি। আবার সামনের দুই দাঁত বের করে হাসতে পারি। সেই হাসি দুনিয়াকে দেখাতে পারি।

মাস্ক পরার অবশ্য সুবিধাও আছে অনেক। রাস্তার ধুলাবালু নাকে-মুখে ঢুকছে না, আমার মুখের গন্ধ অন্যে পাচ্ছে না, আর পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্কের রং ও নকশা বাছাই করে নেওয়ার ফলে নতুন ফ্যাশনও করা যাচ্ছে। কে একজন বলেছে, করোনা যদি আরও কিছুদিন চলে, নতুন প্রজন্ম ভাববে, নাক ও মুখ শরীরের গোপন অংশ, এটা কাউকে দেখাতে হয় না!

মুখোশের ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রস্তর যুগ থেকে মানুষ মাস্ক ব্যবহার করে। ধর্মীয় কারণে, আধ্যাত্মিক কারণে, সামাজিক কারণে, ভূত তাড়াতে, আত্মাকে সম্মান দিতে, মৃতদেহের শেষকৃত্যে, যুদ্ধে, নাটকে, বিনোদনে, শিকারে। আমাদের সুন্দরবনের বাওয়ালিরা মুখের পেছনে মুখোশ পরেন, যাতে বাঘ পেছন থেকে আক্রমণ না করতে পারে। আমরা এটা করে দেখতে পারি। মাথার পেছনে মাস্ক পরলাম। করোনাভাইরাস মাথার পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার চেষ্টা করতে লাগল। বলতে পারেন, তা কী করে সম্ভব। সম্ভব এ কারণে যে জ্ঞান সব সময় বদলায়। আগে কলেরা হলে ডাক্তারেরা পানি খেতে নিষেধ করতেন, এখন বেশি করে পানি, পানীয়, স্যালাইন খেতে বলেন। আগে জ্বর হলে বলা হতো ভাত বন্ধ, বার্লি খাও। এখন বলে, বেশি করে খাও। কাজেই কিছুদিন পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে এটা বলবে না, মাথার পেছনে মাস্ক পরুন, গ্যারান্টি কী?

তবে আমরা মাস্ক পরার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। আমরা রাস্তায় হাঁটার সময় মাস্ক পরি, তারপর ঘরে পৌঁছে—সে ঘর বন্ধুর হোক, অফিসের হোক, দোকান হোক—মাস্ক খুলে ফেলি। আমাদের যখন হাঁচি-কাশি আসে, তখন মাস্ক খুলে হাঁচি-কাশি সেরে নিয়ে তারপর মাস্কটা পরি। মাস্ক পরি থুতনিতে। মাস্কটা হলো গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের মতো, এটা সঙ্গে থাকতে হয়, গাড়ি ফিট কি ফিট নয়, সেটা প্রযোজ্য নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনা নিয়ে প্যারোডি পেলাম। সুকান্তের কবিতার প্যারোডিটা পছন্দ হয়েছে, কপি পেস্ট করে দিলাম।

হে মহাজীবন, আর বেড়ানো নয়,

এবার কদিন বাড়ির ভেতরে থাকো,

নিজের সাথে নিজেই দাও সময়—

বাকি সব কিছু মুলতুবি আজ রাখো।।

রেশনের চাল দুবেলা ফুটিয়ে নেব,

কাজের মাসিকে আজকে দিলাম ছুটি—

করোনা রাজ্যে পৃথিবী দুঃখময়,

রাতের খাবার আলু আর পোড়া রুটি।।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক