বইমেলা শেষ হলো, তারপর?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

১. বিদায় বইমেলা

বাংলাদেশের লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের আনন্দোৎসব একুশের গ্রন্থমেলা ২০২০ শেষ হলো। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আয়োজিত এই মেলা পৃথিবীর দীর্ঘতম বই উৎসব। যেদিন এর অবসান ঘটে, সেই সন্ধ্যায় বিশেষত লেখকদের মন ভার হয়। কোনো কোনো লেখক ফেসবুকে বিদায়ের বিষাদমাখা কথা লেখেন। দীর্ঘ এক মাসের বিক্রয়–ব্যবস্থাপনার কাজে হাঁপিয়ে ওঠা প্রকাশকেরা যদিও ব্যস্ততা–শেষের স্বস্তিতে হাঁপ ছাড়েন, তবু তাঁদেরও মন খারাপ হয়। কারণ, এই বইমেলা থেকেই তাঁদের অধিকাংশের সংবৎসরের আয়ের বড় অংশটা আসে।

পাঠকেরও কিছুটা মন খারাপ হয়; কারণ, বইমেলা ছাড়া অন্য সময় চাহিদামতো বই কেনা তুলনামূলকভাবে কঠিন ও ঝামেলাপূর্ণ। বিশেষত ঢাকার বাইরের সেই সব পাঠকের কথা বলা যায়, যাঁরা শুধু বই কেনার জন্যই এ সময় ঢাকায় আসেন। এই নিবন্ধের লেখক বইমেলায় এমন একাধিক ব্যক্তির দেখা পেয়েছেন, যাঁরা শুধু বই কিনতেই ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দিনের জন্য হলেও সময় বের করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ, লেখক, প্রকাশক, পাঠক—তিন পক্ষেরই মন ভার করে দিয়ে যথানিয়মে বিদায় নিল ২০২০ সালের একুশের বইমেলা। কিন্তু এরপর কী?

প্রথমত, বই বিক্রিতে ভাটার টান শুরু হবে। সে কারণেই কমে যাবে বই প্রকাশের উদ্যোগ। প্রকাশকদের হাত গুটিয়ে বসে পড়ার পালা শুরু হবে। দ্বিতীয়ত, লেখকদের মধ্যে আলস্য ভর করবে; তাঁরা দেখবেন পরের বইমেলা অনেক দূরে। সুতরাং পরের বইটি লেখার, কিংবা শেষ করে প্রকাশের জন্য প্রস্তুত করার জন্য এখনো অনেক সময় হাতে আছে। 

সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বললেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে প্রকাশ করেছে ১০টি বই; আর গত ডিসেম্বর থেকে এই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে প্রকাশ করেছে ৭০টি। অনুপম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মিলন নাথ বললেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রথম ৯ মাসে প্রকাশ করেছে ১৫টি বই, আর পরের তিন মাসে ৩০টি। প্রথমা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল), মাওলা ব্রাদার্স, অবসর প্রকাশনা সংস্থা—এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তারা গল্প, কবিতা, উপন্যাস ছাড়াও নানা ধরনের বই (নন–ফিকশন) সারা বছরই প্রকাশ করে; তবে বইমেলার ঠিক আগের দুই–তিন মাস তারাও বেশিসংখ্যক বই প্রকাশ করে। 

শুধু বইমেলা লক্ষ্য করে বই প্রকাশের এই রীতি পুস্তক প্রকাশনা ও লেখালেখির অঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বইয়ের পরিকল্পনা, বিষয় নির্বাচন, লেখা থেকে শুরু করে তা ছাপিয়ে, বাঁধাই করে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত কোনো কাজেই তাড়াহুড়োর ফল ভালো হয় না। এ বিষয়ে অধিকাংশ প্রকাশকের বক্তব্য, অধিকাংশ লেখক পাণ্ডুলিপি জমা দেন বইমেলার অল্প কিছু সময় আগে। অনেক পাণ্ডুলিপি একসঙ্গে জমা হলে সম্পাদনা, প্রুফরিডিং, অঙ্গসজ্জা, ছাপা, বাঁধাই ইত্যাদি সব কাজের ওপরেই অতিরিক্ত চাপ পড়ে যায়। ফলে বইয়ে ভুলত্রুটিসহ নানা অসংগতি থাকে। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান মনে করেন, বই প্রকাশ বইমেলাকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়, সারা বছরই বই প্রকাশ করা উচিত। লেখকদেরও উচিত এমন সময় পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়া, যাতে প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ বইটির প্রকাশনা মান উন্নত করার জন্য যথেষ্ট সময় পায়। তিনি নিজে বছরের কোন সময় পাণ্ডুলিপি জমা দেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চেষ্টা করেন নভেম্বরের মধ্যেই জমা দিতে, তার পরে নয়। কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান মনে করেন, কোনো লেখকেরই তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করা উচিত নয়; বইমেলার কথা মাথায় রেখেই যদি কেউ বই লেখেন, তাঁর উচিত অন্তত তিন মাস আগে পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়া। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, এই বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি তিনি জমা দিয়েছেন নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। 

২. ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি  

দুনিয়াজুড়ে আওয়াজ উঠেছে, ডিজিটাল পর্দার যন্ত্রপাতির দৌরাত্ম্যের ফলে কাগজের বইয়ের পাঠক ও ক্রেতার সংখ্যা হুহু করে কমে যাচ্ছে; ছাপা বইয়ের মৃত্যু ঘটতে চলেছে। ইউরোপ–আমেরিকায়, বিশেষত শিশু–কিশোরদের বই পড়ার প্রবণতা কমে গেছে—এমন তথ্য নানা জরিপের সূত্রে প্রচারিত হচ্ছে। বইবিমুখতা বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগ থেকে লেখা হচ্ছে Reader, Come Back শিরোনামের বইয়ের মতো অনেক বই, নিবন্ধ, প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র ইত্যাদি।

বাংলাদেশেও আওয়াজটা একই রকমের: বইয়ের পাঠক কমে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু একুশের বইমেলায় বই বিক্রির পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই উল্টো চিত্র চোখে পড়বে। সদ্য শেষ হওয়া বইমেলায় মোট ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৭৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বই। তার আগের এক বছরে বই বিক্রির পরিমাণ বেড়েছিল ৯ কোটি টাকার বেশি। বিস্ময়কর তথ্য হলো, ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ছয় বছরে একুশের বইমেলায় মোট বই বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে ৫ গুণের বেশি (২০১৪ সালে ১৬ কোটি, ২০২০ সালে ৮২ কোটি)।

অর্থাৎ, বাইরের দুনিয়ায় যা–ই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশে বইয়ের বিক্রি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বাড়ার কারণ দুর্বোধ্য নয়; অন্তত একটা কারণ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই ধরা পড়ে। সেটা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার হার বাড়ছে এবং উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আকারও বাড়ছে। কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। এ দেশে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন প্রায় ১৫০। প্রতিবছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করছেন কয়েক লাখ তরুণ–তরুণী। উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর আকার বিশাল এবং তা প্রতিবছরই আরও বড় হচ্ছে।

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে বই বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কারণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার পরিসর অনেক বড়; সেখানে অনেক বেশি স্টলের সংকুলান হয়। এ থেকে এই আভাসই পাওয়া যায় যে আয়োজন আরও বাড়ানো হলে বইয়ের বিক্রি আরও অনেক বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাস্তব। ইউপিএলের স্বত্বাধিকারী মাহরুখ মহিউদ্দিন মনে করেন, জুলাই–আগস্ট মাসে বর্ষাকালীন বই উৎসবের আয়োজন করা যেতে পারে। এটা সরকারি উদ্যোগেই হতে হবে এমন নয়, বেসরকারি উদ্যোগেও হতে পারে। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বড় শহরগুলোতেও বড় আকারের বইমেলার আয়োজন করা যেতে পারে। অর্থাৎ বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে, যেখানে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আকার দ্রুতগতিতে বাড়ছে, সেখানে পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের আরও অনেক প্রসারের সম্ভাবনা প্রবল। প্রয়োজন সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানো। সে জন্য প্রয়োজন বইয়ের প্রকাশ ও বিপণনের উদ্যোগ প্রসারিত করা।

বই বিক্রির পরিমাণ বাড়ার প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উত্থাপন করেছেন উল্লিখিত তিন লেখক। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বললেন, এত বই বিক্রির খবর সাহিত্যের জন্য সুখবর কি না, তা নিয়ে তাঁর সংশয় আছে। তাঁর ধারণা, এভাবে বইয়ের গুণমান রক্ষিত হচ্ছে না। জগতের সব পণ্যেরই গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বইয়ের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে সেই মান নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি কী হবে এবং কারা তা নিয়ন্ত্রণ করবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, এই কাজটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর। তাদের পাণ্ডুলিপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা যোগ্য ব্যক্তিদের সহায়তা নেবে, তাদের সম্পাদনা বোর্ড থাকবে। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক এবং নাসরীন জাহানের বক্তব্যেও শাহাদুজ্জামানের অভিমতের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল।

মানে, বই বিক্রি বাড়ুক, সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা হোক যে বাজে বইয়ের জঞ্জালে বইমেলা ও বইয়ের দোকানগুলো ভরে না উঠুক। বরং ভালো বই আরও বেশি বেশি লেখা হোক, প্রকাশ করা হোক, আরও বেশি বেশি পাঠকের হাতে পৌঁছানোর উদ্যোগ বাড়ুক।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
[email protected]