বইমেলা হোক বসন্তে

অমর একুশে বইমেলা হবে কি হবে না, হলে ভার্চ্যুয়াল হবে, নাকি অ্যাকচুয়াল হবে, এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। না হওয়ারই কথা। কারণ, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, তার অবসান কবে হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক সমিতি, যারা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ফেব্রুয়ারির বইমেলার অন্যতম অংশীদার, দাবি জানিয়েছে, ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ ২০২১ বইমেলা হোক।

আমার নিজের বিচারবুদ্ধিতে আমিও একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলাম, শীতকাল চলে গেলে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বইমেলা হোক। ১১৫টা মন্তব্য পড়েছে। তঁাদের প্রায় সবাই এই প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। কিন্তু দু-তিনজন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলছেন, বইমেলার চেয়ে জীবনের দাম অনেক বেশি। এই ধরনের আয়োজন প্রাণসংহারী হবে। এই মতপ্রকাশকারীদের একজন আমার বুয়েটের সহপাঠিনী। বিদেশে থাকেন। আমি প্রত্যেকের মতকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বিবেচনায় নিতে চাই। নিশ্চয়ই সুস্থতা, বেঁচে থাকা সবার আগে।

তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনার সময়ে বাস্তবতার দিকে তাকাতে হবে। বাংলাদেশে আসলে স্কুল-কলেজ ছাড়া সবকিছু খোলা। বাজারে গাদাগাদি ভিড়। চল্লিশ ফুট বাই চল্লিশ ফুট আকারের আদালতকক্ষে ২০০ মানুষ, ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি করে আছে, বসার বেঞ্চে জায়গা নেই, পেছনে একজনের গায়ে আরেকজন ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় হাজার লোক। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে কনুই ব্যবহার করতে হয়। বাস, ট্রেন, প্লেন চলছে। পর্যটন এলাকাগুলোয় কোনো হোটেলে জায়গা নেই। সবাই বেড়াতে ছুটছেন। প্রথম আলোর কক্সবাজার প্রতিনিধি আবদুল কুদ্দুসকে জিজ্ঞেস করলাম, কী অবস্থা। তিনি জানালেন, ভালো হোটেল সব পূর্ণ। রাস্তায় যানজট, সৈকতগুলোয় ভিড়। ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে মিছিলে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে, আবার ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে মিছিলেও মানুষ দলে দলে যোগ দিচ্ছে। বিজয় দিবসের আলোকসজ্জা দেখতেও ভিড়। সিনেমা হল খুলে দেওয়া হয়েছে, থিয়েটার হলও খোলা। বাজার, মার্কেট খোলা। রাস্তায় যানজট।

সবই যখন খোলা, তখন বইমেলা খোলা থাকলে অসুবিধা কী? খোলা আকাশের নিচে বইমেলা বদ্ধ শপিং মলের চেয়ে কি কম বিপজ্জনক নয়! সত্য বটে, আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পার করছি, প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে, হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হতে পারাই এখন অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। কাজেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। মাস্ক পরা, মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা, এক ঘরে বেশি লোক না থাকা, হাত ধোয়া, নাকে-মুখে-চোখে হাত না দেওয়া, যথাসম্ভব ঘরে থাকা—এসব মানতেই হবে। তবে অক্টোবর মাসে প্রকাশিত জরিপের ফল অনুসারে, এপ্রিল থেকে আগস্টে দেখা গেছে, ঢাকার বস্তিবাসীর শতকরা ৭৪ জনের কোভিড হয়ে গেছে। আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার শতকরা ৪৫ জন করোনাক্রান্ত হয়ে গেছেন। ছয় মাসে যদি ৪৫ ভাগের হয়ে থাকে, এই চার মাসে আরও ৪৫ ভাগের হয়ে যাওয়ার কথা। সমস্যা হলো, দ্বিতীয়বারও মানুষ করোনাক্রান্ত হচ্ছে। তবে সে হার কম। ডিসেম্বর-জানুয়ারির পরে প্রায় সবাই করোনার অ্যান্টিবডি শরীরে নিয়ে ঘুরবেন। ঢাকায় করোনার প্রকোপ কমে আসার কথা। তবে এই অনুমানের ওপরে বসে থাকতে বলছি না। আবারও বলছি, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ভ্যাকসিন আনতে হবে। দেশ রূপান্তর পত্রিকায় দেখলাম, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন থেকে আমাদের ৬ কোটি ৮০ লাখ টিকা পাওয়ার কথা। টিকা সংরক্ষণের ফ্রিজ আমাদের দেশে আছে, আর যা লাগবে, তা কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে। এসব চলতে থাকুক।

করোনার আঘাত যখন পৃথিবীতে প্রথম এল, তখন দুই রাত আমি আতঙ্কে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম। যাকে বলে প্যানিক অ্যাটাক। এত ঘন বসতির দেশ! সবাই গাদাগাদি করে থাকি। চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল। দেশে করোনার মহামারি দেখা দিলে কী হবে? রাস্তায় রাস্তায় কি লাশ পড়ে থাকবে? আর সবার কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেলে দেশে তো দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। এই সময় আমাদের নীতিনির্ধারকেরা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা কলকারখানা খুলে দেন। যানবাহনও খুলে দেন। এই বাজিতে নীতিনির্ধারকেরা জিতেছেন। আমাদের রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে নেই। দুর্ভিক্ষেরও শঙ্কা দেখছি না। বহু লোক কাজ হারিয়েছেন, গরিব প্রান্তিক মানুষের জন্য এখনো সরকারের করণীয় আছে। তা সত্ত্বেও বলব, করোনা মোকাবিলায় সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ার নীতি সঠিক ছিল। ডিসেম্বর-জানুয়ারি করোনা পরিস্থিতি খারাপ যাবে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে উন্নতি হওয়া উচিত। মাঘের শেষে ফাল্গুন আসবে। শীত কমে গেলে পরিস্থিতি ভালো হবে—এই হলো আশা। আর শতকরা ৯০ ভাগ লোকের কোভিড হয়ে গেলে সংক্রমণের হার নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়া উচিত।

এসবই অনুমান। অনুমান দিয়ে চলা যাবে না। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখব ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় অর্ধে বইমেলা করার। যদি দেখা যায় কোভিড পরিস্থিতি খারাপ, তাহলে এক দিনের নোটিশে মেলা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। মুজিব বর্ষের ১৭ মার্চের মহা আয়োজন ৮ মার্চে প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু পরিবার উদ্‌যাপন কমিটিকে ডেকে স্থগিত করতে বলেন, আয়োজনগুলো ভার্চ্যুয়ালি করা হয়। সেই সুযোগ সব সময়েই খোলা থাকছে।

কাজেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিক। বাংলা একাডেমি প্রস্তুতি নিক। ফেব্রুয়ারি আসতে আরও দেড় মাস বাকি আছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে বারবার বসে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা যাবে। আপাতত আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পারি, শীতের অবসানে বসন্তের আগমনে আমরা বইমেলা করব। আর তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। কী কী স্বাস্থ্যবিধি ও সতর্কতা মানতে হবে, তার একটা নির্দেশিকা অবশ্যই দিতে হবে। স্টলের সংখ্যাও কমিয়ে আনা যেতে পারে।

আবুল হাসানের কবিতা আছে: ‘মারী ও মড়কে যার মৃত্যু হয়, হোক, আমি মরি নাই, শোনো। কেউ কোনোদিন কোনো অস্ত্রে আমার আত্মাকে দীর্ণ মারতে পারবে না।’

আর আত্মা কথাটা এলেই আমার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নোবেল পুরস্কার ভাষণের সেই কথাগুলো মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, মানুষের অবসান মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি। মানুষের পরাজয় নেই, তা এ জন্য নয় যে তার ভাষা আছে, তা এ জন্য যে তার আত্মা আছে।

বাঙালিরও আত্মা আছে। পয়লা বৈশাখে, স্বাধীনতা দিবসে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে লাখ লাখ মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসে, সে তো তার সেই অপরাজেয় আত্মার ডাকেই। আমি তো পয়লা বৈশাখে দেখেছি, পোশাকশিল্পের মেয়েরা শাড়ি পরে মাথায় ফুলের মুকুট পরে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে।

করোনার কাছে বাংলাদেশ হেরে যায়নি। মধ্য ফেব্রুয়ারি আসতে আরও পাকা দুই মাস আছে। আগেভাগে হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। দুই মাস পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং বইমেলা হবে—এই আশা এবং প্রস্তুতি আমাদের ধরে রাখতে হবে।


আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক