বন্যা আর কৃষকের হাহাকার, দুটোই বাড়বে

১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত বন্যার সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, কয়েক দিন বন্যার পানি কমতে শুরু করার পর আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে জামালপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলায়। অর্থাৎ, আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল উত্তর-পূর্ব ভারতে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ার ও তার প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলেগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত কিংবা আরও অবনতির যে সম্ভাবনার কথা বলেছিল, তা বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। গত ৩ সপ্তাহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হলেও এই সপ্তাহ থেকে দেশের মধ্যাঞ্চল যেমন মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তৈরি করা বন্যা মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে (২১ জুলাই পর্যন্ত) ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর প্রায় প্রতিটি স্থানে বন্যার পানি বিপৎসীমার ১ মিটার কিংবা তার চেয়ে বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। জুলাই মাসের ১৯ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর দিকে ভারতের হিমালয় পর্বতের পাদদেশ এবং আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে ব্রহ্মপুত্র, যমুনার তীরবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি এই সপ্তাহেও অব্যাহত থাকবে কিংবা আরও অবনতি হতে পারে।

চলমান বন্যা পরিস্থিতির জন্য আরও বড় দুঃসংবাদ হতে পারে গঙ্গা ও পদ্মার অববাহিকায় জুলাই মাসের ১৫ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত হওয়া অতিবৃষ্টি। এ কারণে ইতিমধ্যেই ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গঙ্গার ৩টি প্রধান উপনদীর পানি প্রবাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে (২১ জুলাই পর্যন্ত) ইতিমধ্যেই সপ্তকশি নদীতে দ্বিগুণ, গণ্ডকী নদীতে সাড়ে তিন গুণ এবং ঘোগরা নদীতে গড় প্রবাহের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই ঢল ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ফারাক্কা বাঁধে উপস্থিত হবে ও বাঁধ কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরের মতো এবারও বাঁধের সব গেট খুলে দিতে বাধ্য হবে। এর ফলে এক সপ্তাহের মধ্যে পদ্মা ও তার শাখা নদীর অন্তর্গত জেলাগুলোতে বন্যা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। অর্থাৎ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর পাশাপাশি ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চল এবং দেশের মধ্যাঞ্চলের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। তা ছাড়া, আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থার ‘গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেম’ নামের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল নির্দেশ করছে, ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ রাজ্যে জুলাই মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে।

বন্যার এ বিপুল জলরাশি বঙ্গোপসাগরে নেমে যাওয়ার গতি ধীর হওয়ার আর সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে আবহাওয়া পূর্বাভাসের গাণিতিক মডেল। জুলাই মাসের ২৮ তারিখের পরে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে তা বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দিকে আগস্ট মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপগুলো যখন উপকূলীয় এলাকার দিয়ে অগ্রসর হয়, তখন উপকূলীয় এলাকার সমুদ্র সমতলের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। সম্ভাব্য নিম্নচাপটি যখন উপকূলীয় এলাকায় পৌঁছাবে (আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে) তখন পূর্ণিমা অবস্থার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানির সঙ্গে নিম্নচাপের প্রভাব যুক্ত হয়ে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার গতি হ্রাস করতে পারে।

ওপরে বর্ণিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতি আরও বিস্তৃত হওয়ার এবং তা আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২০ জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় ২৮ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। বন্যার কারণে বাড়িঘর ও ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৬ লাখ মানুষ (দৈনিক প্রথম আলো, ২১ জুলাই, ২০২০ )। পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সরকার উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে বেশি ছাড়া কম হবে না। ২০২০ সালের বন্যার কারণে প্লাবিত এলাকার পরিমাণ ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ সালের বন্যার মতো ততটা বিস্তৃত না হলেও এ বছর অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় ধরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকবে বন্যাকবলিত অনেক এলাকা। চলমান বন্যা পরিস্থিতি এখনো মধ্যবর্তী ও বন্যা শেষ হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও কৃষি সম্পদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, তা হলফ করেই বলা যায়। দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষকদের দ্রুত পুনর্বাসনে অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে।

পাবনা জেলার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ‘ত্রাণ নেই, ভিজিএফের চালই কিছু ভরসা’ (দৈনিক প্রথম আলো, ২১ জুলাই )। একই দিনে প্রকাশিত অন্য একটি লেখায় তুহিন ওয়াদুদ মন্তব্য করেছেন, ‘যে জেলায় বন্যা হয়নি সেই জেলায় যা বরাদ্দ, যে জেলায় তিনবার বন্যা হয়েছে, সেই জেলার জন্যও একই বরাদ্দ। অতীতে দেখা গেছে, নদী নেই বা নদীভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন একটি জেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছিল—ওই জেলার ৪ ব্যক্তি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কর্মরত থাকার কারণে।’ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বন্যা-পরবর্তী ত্রাণ বিতরণে অব্যবস্থাপনার চিত্র বুঝতে ওপরের দুটি উদাহরণ যথেষ্ট। দেশে চলমান করোনা মহামারির কারণে বড় শহরগুলোতে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত মানুষ যেমন রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিকসহ অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবন নির্বাহ করার চেষ্টা করছিলেন। বন্যা পরিস্থিতি সেসব শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতাকে আরও বিপন্ন করে তুলেছে।

পরিশেষে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সব জেলায় সমান বরাদ্দ নীতিমালা সংশোধন করে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ অনুসারে বরাদ্দ করা হোক। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর কৃষিঋণের সুদ মওকুফ করে নতুন কৃষিঋণ বিতরণ করার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সরকার করোনা পরিস্থিতির কারণে ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে ২৫০০ টাকা করে যে আর্থিক সাহায্যের উদ্যোগ নিয়েছে, তা শুধু নিশ্চিত করাই নয়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার নাগরিকদের জন্য তা বর্ধিত করা জরুরি।

মোস্তফা কামাল: আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক। স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাস্টেনিবিলিটি, সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
[email protected]