বলকানে ফিরছে তুরস্ক, মূল্য দিতে হবে ইইউকে

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সার্বিয়া সফরে যাচ্ছেন
ছবি : রয়টার্স

সম্প্রতি ইউক্রেন ও মলদোভাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রার্থিতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে মনে করছেন ইইউ নেতারা। যদিও চূড়ান্ত ‘মুহূর্তে’ পৌঁছাতে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, সেটা পরিষ্কার করে বলেননি তাঁরা। ইইউর কাছ থেকে প্রার্থিতার মর্যাদা পাওয়া অনেক রাষ্ট্র জোটটির ‘চিরস্থায়ী অপেক্ষা কক্ষে’ বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে, অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির জন্য তাদের দরজা খুলে দিয়েছে।

পশ্চিম বলকানে তুরস্কের ভূমিকা বিবেচনা করা যাক। যদিও এখন পর্যন্ত পশ্চিম বলকান ভূরাজনৈতিকভাবে খুব শক্তভাবেই ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটনের বলয়েই রয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সার্বিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে তুরস্ক। অটোমান সাম্রাজ্যের কথা বিবেচনা করলে তুরস্ক ও বলকানের একই ইতিহাস রয়েছে। আবার তুরস্কের সঙ্গে ওই দেশগুলোর একটা কলঙ্কজনক মিল রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রার্থিতার মর্যাদা পেলেও কেউই চূড়ান্ত সদস্যপদ পায়নি। তুরস্ক তো ১৯৯৯ সাল থেকে অপেক্ষা করে আছে। এখন তাই তুরস্ক এবং বলকান মিত্রদের জন্য ইইউর সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটি বিস্মৃতি স্বপ্নের মতো। সার্বিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া ও আলবেনিয়া বিকল্প হিসেবে ‘উন্মুক্ত বলকান’ নামে একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ শুরু করেছে।

তুরস্ক এখন বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। দেশটির এই কৌশল বাস্তবায়নে বলকান খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আঙ্কারা এরই মধ্যে পশ্চিম বলকানের প্রতিটি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে ফেলেছে। এই চুক্তির ফলে তুরস্কের অর্থনীতির আকার নিশ্চিতভাবেই বাড়ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে পশ্চিম বলকানের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি সার্বিয়ার সঙ্গে তুরস্কের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। ২০২১ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছিল ২০০ কোটি ডলারের, এ বছরে সেটা ৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। গত এক দশকে সার্বিয়ায় তুরস্কের বিনিয়োগও ১০ লাখ ডলার থেকে বেড়ে ৩০ কোটি ডলারে ঠেকেছে। এ ধরনের সহযোগিতা আগামী দিনে আরও বাড়বে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সার্বিয়া সফরে যাচ্ছেন। এরদোয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু সম্প্রতি সার্বিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এবং ক্রোয়েশিয়া সফর করেছেন।

সাভাসগলু তাঁর এই সফরে কসোভাতে যান। সার্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২০০৮ সালে দেশটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তুরস্ক স্বীকৃতি দিলেও বেশির ভাগ ইইউ ও বলকান রাষ্ট্র এখনো কসাভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কসোভাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে মতভিন্নতা থাকলেও একটা ত্রিপক্ষীয় অংশীদারত্বের পথে দেশগুলো পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। এ ছাড়া আঙ্কারা শিগগিরই তুরস্ক-বসনিয়া-হার্জেগোভিনা-সার্বিয়া সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। স্থানীয় নেতারা তুরস্কের এই কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।

এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যে ধীরগতি, তাতেই বলকানে তুরস্কের জন্য দরজা খুলে গেছে। ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথটির কোনো শেষ নেই। তাই ইইউর চিরস্থায়ী অপেক্ষা কক্ষে বসে থাকার চেয়ে বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে দেশগুলো।

যদিও বলকানের মুসলমানদের, বিশেষ কাছে বসনিয়ার মুসলমানদের কাছে আঙ্কারা পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তবে তুরস্ক অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। সার্বিয়াতে আঙ্কারা কারখানা খুলছে, ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আবার বসনিয়ায় তারা মসজিদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বসনিকাসদের (বসনিয়ার তিনটি জনগোষ্ঠীর একটি) সঙ্গে সাংস্কৃতিক মৈত্রী স্থাপনে মনোযোগ দিয়েছে। তুরস্ক ও পশ্চিম বলকানের মধ্যকার সম্পর্কের সুফল ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।

তুরস্কের নাগরিকেরা এখন সার্বিয়াতে পাসপোর্টের বদলে নিজেদের বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ কার্ড ব্যবহার করে ভ্রমণ করতে পারেন। ২০১৯ সালে সার্বিয়াতে তুরস্কের পুলিশকে তাদের দেশে অভিযানেরও অনুমতি দেয়। শুধু সার্বিয়ায় নয়, বলকানের অন্য দেশগুলোকেও গুরুত্ব দিচ্ছে আঙ্কারা। সম্প্রতি ওই অঞ্চলের গণমাধ্যম খাতে বিনিয়োগ করেছে আঙ্কারা। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশন টিআরটি ‘তুরস্কের কণ্ঠ’ নামে বলকান অঞ্চলে চালু হয়েছে।

আরও পড়ুন

তুরস্ক ও বলকানের এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এই সম্পর্কের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘বলকান এখন তুরস্ক অথবা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে।’ মাখোঁর উদ্বেগ থেকে এটা পরিষ্কার যে বলকানে নিজেদের স্বার্থের ক্ষতি হোক, এমন কোনো কিছু ইইউর নেতারা চান না। ফলে বলকান তুরস্কের জন্য ইউরোপে প্রবেশের দরজা হলেও খুব তাড়াতাড়ি বলকানের অর্থনীতির প্রধান চালক হতে পারবে না।

এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যে ধীরগতি, তাতেই বলকানে তুরস্কের জন্য দরজা খুলে গেছে। ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথটির কোনো শেষ নেই। তাই ইইউর চিরস্থায়ী অপেক্ষা কক্ষে বসে থাকার চেয়ে বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে দেশগুলো।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

নিকোলা মিকোভিচ সার্বীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের বিদেশনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ