বহুত্ববাদী ভারতে একদেশদর্শী বিজেপি চূড়ান্ত বিচারে বিজয়ী হবে না

বহুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয় ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের কাছে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদ তথা ‘এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা’ তত্ত্বের পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। অনেকে হয়তো বলবেন, এই খণ্ড চিত্র দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা অযৌক্তিক। বিজেপি যখন আসনসংখ্যা ৩ থেকে ৭৭-এ উন্নীত করেছে এবং ভোট যখন ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে, তখন এ কথা বলা যাবে না।

কিন্তু এই ব্যাখ্য্যা অযৌক্তিক নয়, কারণ বিজেপির প্রধান সব নেতার বহুবারের বহুবিধ প্রচার, অর্থ, মিডিয়া সাপোর্ট আর দীর্ঘদিনের বহুবিধ ব্যাপক গ্রাউন্ড ওয়ার্ক—সব ব্যর্থ হয়ে গেছে ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের কাছে। অতএব এই ব্যাখ্যাই যথার্থ ব্যাখ্যা।  

ভারতের সমাজ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, যার বুকে সে বিচিত্র ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ভারতের আত্মা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ধারক এবং ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে ভারত তার এককত্ব হারাবে, অখণ্ডতা বিনাশ হবে, অকালমৃত্যু ঘটবে। সব মত, সব পথ তো বটেই, নাস্তিককেও বঞ্চিত করে না প্রাচীন ভারতের বেদ, বেদান্ত, সংহিতা আর উপনিষদ, যা সনাতন ধর্ম নামে পরিচিতি পেয়েছে আদিকাল থেকেই। অতএব বিজেপির হিন্দুত্ববাদ সনাতন ধর্মেরও পরিপন্থী।

স্বামী বিবেকানন্দ বেদান্ত দর্শনের সিংহভাগ শিক্ষার একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বৈদান্তিক দর্শনকে, সনাতনী দর্শনকে তিনি খুব উচ্চ মূল্য দিয়েছিলেন এবং তা তিনি বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করতে খুব গর্ব অনুভব করতেন।

তবে বেদান্তের শিক্ষাকে, সনাতন ধর্মের শিক্ষাকে তিনি ইহজাগতিকতার আলোকে গ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারতে মুসলমানের আগমন ও বসবাস একটি বাস্তবতা। এটি ঘটে গেছে। এখন হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ছাড়া গতি নেই। রামকৃষ্ণ উদ্ভাবিত তত্ত্ব ‘যত মত তত পথ’-এর এক শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন তাঁর শিষ্য নরেন, যিনি নাস্তিক নরেন হিসেবে দেখা করতে গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে।

নরেন অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দ এ-ও বলেছেন, ‘আমি এমন একটা ভারত চাই যার মস্তিষ্ক হবে বৈদান্তিক আর দেহ হবে ইসলামিক।’ ‘ইসলামিক দেহ’ বলতে তিনি একটি কুসংস্কারহীন, জাতপাতহীন ও সমতাভিত্তিক সমাজ বুঝিয়েছিলেন। এ জন্যই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী পালিত হয়। মা সারদার একটি বিখ্যাত উক্তি তাঁর শিষ্যরা প্রায়ই আউড়িয়ে থাকেন, ‘বাসুদেবও আমার ছেলে, রফিকও আমার ছেলে।’

অমর্ত্য সেন প্রাচীন ভারতে হিন্দু দর্শনের মধ্যকার বস্তুবাদী তথা নাস্তিক্যবাদী স্কুল লোকায়ত-এর একান্ত অনুরাগী। বস্তুত এই লোকায়ত দর্শনই তাঁকে নিরীশ্বরবাদী হতে সাহায্য করে। তাঁর গর্বের জায়গটা হলো প্রাচীন ভারতের বহুত্ববাদ ও যুক্তির আশ্রয়। আয়ুর্বেদের বিজ্ঞানও তাঁকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। বস্তুত সনাতন ধর্ম সমাজে নাস্তিকের অস্তিত্বকে অনুমোদন করে, তাঁর অবস্থানকে মেনে নেয়।

প্রফেসর সেন আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়া নামে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করে প্রাচীন ভারতে, বিশেষ করে, চার্বাকের বস্তুবাদী ও লোকায়ত দর্শনের মাহাত্ম্যের কথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। এমনকি ঋগ্বেদের সৃষ্টির সংগীত অধ্যয়ন করে অমর্ত্য যখন দেখেন ধর্মের মধ্যেও সংশয়বাদের ঐতিহ্য বর্তমান, তখন তিনি দারুণভাবে চমকিত হন, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে গান্ধী সারা জীবন হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেছেন। বাঙালিদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎ বসু, ঋষী অরবিন্দ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তি এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের চেষ্টা করেছেন।

জাহিরুল হাসান নামে এক প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: মুসলমান সমগ্র নামে ৩০৩ পৃষ্ঠার একটি বই সংকলন করেছেন, সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্য-গল্প-উপন্যাসে যেসব মুসলমান চরিত্র এবং প্রবন্ধ-বক্তৃতায় যেখানে মুসলমান প্রসঙ্গ এসেছে, তা টীকাসহ বিবৃত করেছেন। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন বাঙালি হিসেবে আত্মসমালোচনা করে গেছেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

জাহিরুল হাসানের সেই সংকলনে এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন: ‘আমাদের একটা মস্ত কাজ আছে, হিন্দু-মুসলমানে সখ্যবন্ধন দৃঢ় করা। অন্য-দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলা দেশে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।... কিন্তু আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। তাঁহারা নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে শজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারি দিকে কন্টকিত করিয়া রাখিয়াছে; কাহারও কাছে ঘেঁসিবার জো নাই।’

প্রায় একই কথা তিনি আরেক জায়গায় বলেন এভাবে: মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে মিশিতে চায়, একাত্ম হইতে চায়, কিন্তু হিন্দুদের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলে না।
হিন্দুর ঘরে জন্ম নেওয়া যেসব মনীষীর কথা বলা হলো, তাঁরা কেউই ধর্মের গণ্ডিতে বাঁধা থাকেননি। তাঁরা সবাই মানবিকতাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু, ঋষী অরবিন্দ—সবারই আন্তর্জাতিক পরিচিত ছিল। ভারতের যেকোনো নাগরিকের এঁদের নিয়ে গর্ব করার কথা।

কিন্তু বিজেপি এঁদের কাউকে নিজের ভাবা তো দূরের কথা, কারও শিক্ষা-দর্শনই গ্রহণ করেনি। তারা সুভাষ বসুর কথা মাঝেমধ্যে বলে কিন্তু তা এক শ ভাগ মেকি, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের জন্য তারা এ কথা বলে। কারণ যে বিজেপি এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্মে বিশ্বাস করে, তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সুভাষ বসুকে সহ্য করার কথা নয়।

বিজেপি যে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, তা ব্যাখ্যার অতীত। ব্যাগের মধ্যে গোমাংস বহন করার সন্দেহে ট্রেনের মধ্যে কিশোর ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, আদিত্য যোগীর সভা থেকে মুসলিম নারীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া, রাস্তাঘাটে, ট্রেনে, বাসে মুসলমানদের জোর করে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করা ইত্যাদি ঘটনা এই বিষবাষ্পের সাক্ষ্য বহন করে।

নোবেল প্রাপ্তির আগপর্যন্ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মৌলবাদী হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিগৃহীত ও অপমানিত হয়েছিলেন। নোবেল পাওয়ার পর কলকাতাবাসী তাঁকে সংবর্ধনা দেয় কিন্তু এই নিগ্রহ ও অপমান রবীন্দ্রনাথের মনে এতই দাগ কেটেছিল যে তাঁর বক্তৃতায় এ নিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় কথা বলেছিলেন।

বর্তমান পৃথিবীতে অর্থনীতি, দর্শন, গণিত শাস্ত্রসহ এতগুলো বিষয়ে অমর্ত্য সেনের মতো এ রকম উচ্চতায় আর একজন মানুষও নেই অথচ বিজেপি তাঁকে যেভাবে অপমান করেছে, তা বর্ণনাতীত। অমর্ত্য সেনেরই প্রতিষ্ঠা করা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদ ছেড়ে আসতে বাধ্য করা হয় তাঁকে। সর্বশেষ নরেন্দ্র মোদির নিয়োগ পাওয়া বিশ্বভারতীর উপাচার্য, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী অমর্ত্য সেনকে আক্ষরিক অর্থেই জমি চোর হিসেবে অভিহিত করেছেন।

সবচেয়ে যে ক্ষতি বিজেপি করল তা হলো, ৭০ বছর ধরে ভারত যে প্রতিষ্ঠানগুলো তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল, নরেন্দ্র মোদি সরকার তা ধ্বংস করে দিচ্ছে একে একে। পুলিশ বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন—এমনকি ইতিহাস কমিশনে হস্তক্ষেপ করে, দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে।

নরেন্দ্র মোদির গুজরাটের আপাত সাফল্যকে অনেক অর্থনীতিবিদকে সুশাসন বলে ভুল করতে দেখেছি, মোদির প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখেছি। কিন্তু এখন তাঁদের সবারই ভুল ভেঙেছে, মোহমুক্তি ঘটেছে।

রবীন্দ্রনাথ সর্বংসহা, বহুত্ববাদী ভারতের জয়গান করেন। সবাইকে ভারত সাগর তীরে এসে দাঁড়াতে আহ্বান করেন:
...
এসো হে আর্য, এসো অনার্য
হিন্দু মুসলমান।
এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার
...
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবার-পরশে-পবিত্র-করা
তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
[email protected]