বাংলাদেশ ও ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দ্বৈরথ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও) প্রকাশ করেছে। তাতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে আগামী বছরেই ভারত ঘুরে দাঁড়াবে, মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশকে আবার ছাড়িয়ে যাবে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে।

মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সংবাদ সম্প্রতি জানা গেলেও বেশ কিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটিকে ছাড়িয়ে গেছে আরও ছয় বছর আগে। যেমন নারীশিক্ষায় ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের হার বেশি এবং নারীপ্রতি জন্মহার কম। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হারও কম।

এসব বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া

ভারতের আলোচনায় দুটি ধারা রয়েছে। ইতিবাচক ধারায় এ বিষয়ে আত্মানুসন্ধান শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, পাঁচ বছর আগেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল, সেখানে কেন এমন হলো? এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সাংবাদিক শেখর গুপ্ত দেশটির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডির মন্তব্য ‘ভারতের নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে দেবে’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে সম্মানের সঙ্গে কথা বলা।

ছোট দেশকে তুচ্ছ করার পরিণতি আমাদের সামনেই আছে। ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর স্বাধীন হওয়ার আগে সে দেশের নেতা লি কুয়ান ইউ মালয়েশীয় পার্লামেন্টে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা ছোট দেশ হতে পারি, সম্পদহীন হতে পারি, কিন্তু আমরা একদিন সিলোনের (শ্রীলঙ্কার পূর্ব নাম) মতো সমৃদ্ধিশালী দ্বীপরাষ্ট্র হব।’ বাকি ইতিহাস সবারই জানা।

অন্যদিকে, বিজেপির মুখপাত্র অর্থনীতিবিদ সঞ্জু ভার্মা বলেছেন, বর্তমান মূল্যে ভারতের জিডিপি ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর বাংলাদেশের জিডিপি মাত্র ৩৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই তাঁর মতে, ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতি, যা ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে পেছনে ফেলে এসেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনা বাতুলতামাত্র। বিজেপির মুখপাত্র অর্থনীতিবিদের মন্তব্য সঠিক নয়। কেননা, মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে দেশের জনসংখ্যার ভিন্নতা আমলে নেওয়ার ফলে জিডিপি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। সামাজিক মাধ্যমে আরেকটি বক্তব্য এমন: ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে, অথচ সেই বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটিও সঠিক নয়। ভারত নিজের স্বার্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ নিজেই স্বাধীন হয়েছে, কেউ স্বাধীন করে দেয়নি।

বাংলাদেশে আইএমএফের পূর্বাভাসের প্রতিক্রিয়া ভারতের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলায় জয়লাভের মতো আবেগ ও উচ্ছ্বাসে ভরা। আশার কথা, আমাদের কোনো মন্ত্রী এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি।

বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বলা যায়, ভারতের সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আইএমএফ এযাত্রায় বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনা থেকে রক্ষা পেল। যেখানে বাংলাদেশ বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ; আইএমএফ বলছে, ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার বাংলাদেশ বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, আইএমএফ বলছে, এটা হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

আসলে বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ

প্রথমত, আইএমএফের প্রতিবেদনটি একটি পূর্বাভাসমাত্র, যা পরিবর্তনশীল। সংস্থাটি ইতিমধ্যে তাদের আগের পূর্বাভাস থেকে সরে এসেছে। দ্বিতীয়ত, মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়; সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জেনেছি, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩—এই তিন বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি, ভারত আমাদের অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিশ্ব অর্থনীতি কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অস্থির সময় পার করছে। তাই এখনকার পূর্বাভাসগুলো খুব নির্ভরযোগ্য নয়। আমার এক বন্ধু রসিকতা করে বলেছেন, করোনার পরে বাংলাদেশিদের ভারতে যাতায়াত আবার শুরু হলেই সে দেশে আমাদের ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যয় বহুলাংশে বাড়বে। ফলে, ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বেড়ে যাবে আর বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ কমে যাবে। সবশেষে, শ্রীলঙ্কা বহু আগেই মাথাপিছু জিডিপি ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারতকে পেছনে ফেলে গেছে। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

শেষ হাসি কার হবে

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নির্ধারক বিষয়গুলো, যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ, কারিগরি জ্ঞান, সঞ্চয়ের হার, কর-জিডিপির অনুপাত এবং বিদেশি বিনিয়োগ—সব বিবেচনাতেই বাংলাদেশের তুলনায় ভারত এগিয়ে আছে। কিন্তু ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান অন্তরায় সামাজিক। সেটা ব্যাখ্যা করতে পাঠকের সঙ্গে খানিকটা গল্প করতে হয়।

আমি তখন সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণের উদ্যোগ নেন। ফলে ভারত সম্পর্কে বিশাল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ১৯৯৩ সালে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ভারত অচিরেই চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। সেমিনারে ভারতীয় ও চীনা বংশোদ্ভূত-নির্বিশেষে সবাই এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। আমি সভায় বলি, প্রতিবেশী হওয়ার কারণে ভারতের উন্নয়নে বাংলাদেশের বিশেষ স্বার্থ আছে। আমি ভারতে তখন অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের উদাহরণ টেনে বলি, সে সময় বাংলাদেশের নির্মাণশ্রমিকেরা দিল্লি গিয়ে কাজ করেন। তবে সন্দেহ আছে, ভারত দেশ হিসেবে এগোবে কি না। আমার ধারণা, অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে ভারতে বিচ্ছিন্ন সমৃদ্ধ জনপদ ও ধনী ব্যক্তির উদ্ভব হবে। কিন্তু ভারতব্যাপী উন্নয়ন ঘটবে না।

কথা শেষ না হতেই সবাই একযোগে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। চীনা ও মালয় বংশোদ্ভূত অধ্যাপকেরা আমার বক্তব্যের ভিত্তি জানতে চান। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক অধ্যাপক তির্যক মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশ একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল; তাই আমি এর ঘোর তখনো কাটাতে পারিনি। আসলেও আমি তখন কোনো তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মন্তব্যটি করিনি। আমি তখন সবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান লেখক রোহিন্তন মিস্ত্রির লেখা উপন্যাস আ ফাইন ব্যালান্স পড়ে শেষ করেছি। সেখানে ভারতীয় সমাজের বিভক্তি ও উচ্চবর্ণের লোকদের দ্বারা নিম্নবর্ণের লোকদের নিপীড়নের যে চিত্র পাই, তাতে আমার মনে হয় সামাজিক সংস্কার না করে কেবল অর্থনীতির উদারীকরণ খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। আমার মন্তব্যের ভিত্তি ছিল এটাই। অর্থনীতির শিক্ষক হয়ে কল্পকাহিনির ওপর ভিত্তি করে মত দিয়েছি, সে কথা সভায় চেপে যাই। যাহোক, ভারত যদি চীন থেকে এগিয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি হব—এ কথা বলে আমি কোনোমতে গা বাঁচাই।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়; আমি ২০১৫ সালে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অধ্যাপক বন্ধুটি আমাকে দেখতে আসেন। এ কথা-সে কথার পর তিনি আমাকে বলেন, ‘সেই সেমিনারে ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য বেশ দূরদর্শী ছিল। সেটা আপনি কীভাবে পেয়েছিলেন?’ আমি বিজ্ঞ অধ্যাপকের ভান করে তাঁকে বলি, সিক্সথ সেন্স, মাই ফ্রেন্ড! জাত-বৈষম্যের সঙ্গে আজ ভারতে যোগ হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়ন।

ভারতের তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দৌড়ে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা অনেক। তবে বাংলাদেশের বড় সম্পদ হলো এ দেশের মানুষের অদম্য মনোভাব। এ দেশের কৃষক পেঁয়াজ ও দুধের দাম না পেয়ে তা রাস্তায় ফেলে দেন। তা সত্ত্বেও আবার একই ফসলের বাম্পার ফলন ঘটান। আমাদের শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি না পেলেও খাদ্যশস্য, চা ও তৈরি পোশাকের উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছেন। ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের কেবল চাই সুশাসন ও দুর্নীতি হ্রাস।

আমরা চাই, শুধু ভারত-বাংলাদেশে নয়, সারা উপমহাদেশেই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক, জাতপাতের বৈষম্য দূর হোক, সাম্প্রদায়িক হানাহানির অবসান হোক, আর অব্যাহত থাকুক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। কেননা প্রতিবেশী দেশগুলো একই সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে, প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় কারও কোনো ক্ষতি হয় না।


মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ