বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগ কত

ডলারছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে অনেক বছর ধরেই। তবে অর্থনীতির আয়তন ও সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে মিল রেখে এখনো যথেষ্ট বিদেশি বিনিয়োগ টানা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। এ থেকে ফেরত যাওয়া বা প্রত্যাহার হওয়া বিনিয়োগ বাদ দিয়ে নিট বা প্রকৃত বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ২৮৮ কোটি ডলার। আর ২০১৮ সালে এই নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৬১ কোটি ডলার। মানে, এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে ২০ শতাংশ। যদিও করোনাভাইরাস তখনো হানা দেয়নি, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিও ধীর হয়নি।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কেন কমে গেছে বা কেন যথেষ্ট বাড়ছে না, তা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও কথাবার্তা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও বিদেশে বিনিয়োগের বিষয়টি এখন সামনে উঠে আসছে। একশ্রেণির বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগ করার জন্য অনুমতি চেয়ে অনেক দিন ধরেই দাবি জানাচ্ছিলেন। এখন পর্যন্ত ঢালাওভাবে এ রকম বিনিয়োগ করার কোনো নীতিগত ও আইনগত সুযোগ নেই। তবে সরকারের ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশে টাকা পাঠানো ও সেই টাকা থেকে বিনিয়োগের বিধান রয়েছে। এই আইন মেনে গুটিকয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশ থেকে বাইরে পুঁজি নিয়ে গিয়ে বিনিয়োগ করেছে। যেমন ২০১৩ সালে এমজেএল বাংলাদেশ মিয়ানমারে ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে। ২০১৭ সালে আকিজ গ্রুপ মালয়েশিয়ার রবিন রিসোর্সেস কিনে নিতে প্রায় আট কোটি ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পায় মন্ত্রিপরিষদের কাছ থেকে। ২০১৮ সালে এই লেনদেন সম্পন্ন হয়।ক

বৈধ পথে যে অর্থ স্থানান্তর ও বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়, সেটার পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে অসুবিধা কোথায়? আসলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঠিকমতো তুলে না ধরার বা গোপন করার যে প্রবণতা দেশে গড়ে উঠেছে, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ ধরনের তথ্যের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বা নীরবতা বরং বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি করে, বিভিন্ন সন্দেহ জাগিয়ে তোলে

এভাবে ঢালাও অনুমতির বদলে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগের জন্য অর্থ স্থানান্তরের যে অনুমতি দিচ্ছে, তা-ও যৌক্তিক। দুই দশক আগে চলতি হিসাব অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হলেও মূলধনি হিসাব বিনিময়যোগ্য করা হয়নি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষার জন্য। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ বিভিন্ন সময়ে মূলধনি হিসাব অবাধে খুলে দিয়ে যে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল, তার আলোকে এই ধরনের বিধিনিষেধ বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য।

তবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ঠিক কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বৈধ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার কোনো সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত মেলে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালে সর্বশেষ এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল। তারপর থেকে এটি প্রকাশ করা বন্ধ আছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিবেদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে যে উপাত্ত পেয়ে থাকে, তাতে দেখা যায় যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ কোটি ২০ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর গত বছর প্রকৃত হিসাবে বিদেশে কোনো বিনিয়োগ হয়নি।

বাংলাদেশ বা যেকোনো দেশ থেকেই ঘোষিত বিদেশে বিনিয়োগের অর্থ সাধারণত বৈধ পথে স্থানান্তরিত হয়। তাই এটির সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট হিসাব থাকার কথা। যা বৈধ পথে যায় না, তার হিসাব পাওয়া খুব কঠিন হয়। আর সেটি টাকা পাচার হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার কিছু অর্থ অনুমোদন ছাড়াই বৈধ পথে নানা কৌশলে স্থানান্তরিত হয়, যা চিহ্নিত করাও বেশ দুষ্কর।

আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশি বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা যথাযথ নয় বলেও মনে করার অবকাশ আছে। আকিজ গ্রুপ ২০১৮ সালে ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের লেনদেন সম্পন্ন করেছে মালয়েশিয়ার দুটি কোম্পানি কেনার জন্য। এর মধ্যে দুই কোটি ডলারই গেছে আকিজের রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটায় সংরক্ষিত অর্থ থেকে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

এটা ঠিক, লেনদেনের ভারসাম্যের যে বিস্তারিত পরিসংখ্যান বাংলাদেশে ব্যাংক প্রতিবছর প্রকাশ করে, তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ প্রেরণ ও বিনিয়োগের তথ্য থাকে। কিন্তু সাধারণ জনগণ তো বটেই, গবেষকদের পক্ষেও সেখান থেকে মূল তথ্যটি উদ্ধার করা দুঃসাধ্য। সুতরাং, বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে বিদেশে বাংলাদেশি বিনিয়োগ বিষয়ে প্রতি ছয় মাস অন্তর বা বছরে বিস্তারিত তথ্য-পরিসংখ্যানসংবলিত একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় কথা, বৈধ পথে যে অর্থ স্থানান্তর ও বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়, সেটার পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে অসুবিধা কোথায়? আসলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঠিকমতো তুলে না ধরার বা গোপন করার যে প্রবণতা দেশে গড়ে উঠেছে, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ ধরনের তথ্যের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বা নীরবতা বরং বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি করে, বিভিন্ন সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। অথচ তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণসহযোগে নিয়মিত প্রকাশ করলে অস্বচ্ছতা ও বিভ্রান্তি দূর হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিদেশি বিনিয়োগপ্রাপ্তির বিষয়ে ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে অনেক বছর ধরে, সেটাই তো তার একটি প্রমাণ।

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক

[email protected]