
মাঝে মাঝে খবরে দেখা যায়, অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে বাংলাদেশিরা ধরা পড়ছেন। গত কয়েক সপ্তাহে এ রকম বেশ বড় কয়েকটি দল ধরা পড়েছে বঙ্গোপসাগর থেকে, এঁদের মধ্যে কেবল পুরুষ শ্রমিক ছিলেন না, ছিলেন নারী ও শিশুরাও। শুধু মালয়েশিয়াগামী নয়, অন্যান্য দেশেও এভাবে পাড়ি দেওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। সেসব ঘটনার অনেকগুলোই ধরা পড়ে না বলে আমাদের গোচরে আসে না। কয়েক মাস আগে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্য থেকে এ রকম অবৈধভাবে সে দেশে পাড়ি দেওয়া বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের একটি বড় দল ধরা পড়েছে থাই পুলিশের হাতে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের একটি বড় দল ছিল। এ রকম বেপরোয়া নিরুপায় দেশত্যাগের পেছনের মূল কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশু মিলিয়ে বছরে গড়ে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বিদেশে পাচার হয়।
এর মধ্যে মাত্র কয়েক দিন আগে মালয়েশিয়া সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে অন্যান্য চুক্তির সঙ্গে জনসংখ্যা রপ্তানিবিষয়ক চুক্তিও ছিল, ছিল ভিসা-প্রক্রিয়া শিথিল করার চুক্তি। একটি দেশের নাগরিকেরা যখন ব্যাপক হারে অবৈধপথে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন, কখনো বা চেষ্টা ব্যর্থ হলে ধরা পড়ছেন, তখন সেই দেশের জন্য ভিসা-প্রক্রিয়া শিথিল করার কাজটি কীভাবে করা হবে, সেটি বোধগম্য নয়। বর্তমানে সম্ভবত লাখ ছয়েক বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় কর্মরত। এই বিশাল সংখ্যার প্রায় অর্ধেকই রয়েছেন অবৈধভাবে। তবে খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী আরও ৬০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং প্রায় কাছাকাছি সময়ে উপর্যুপরি কয়েকটি অবৈধ অভিযাত্রী দলের মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়া ধরা পড়ার ঘটনা কাকতালীয় হলেও তাৎপর্যময়। আরও অনেক দেশেই আমাদের সরকারপ্রধানের সফরের ঘটনা ঘটে, এমনকি বহু দেশেই বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের অস্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু বিশেষ করে মালয়েশিয়ার কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য ভিন্ন। অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা, গত শতাব্দীর মধ্য সত্তরের দশকেও (১৯৭৪-৭৫) মালয়েশিয়ায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব ছিল। এই অভাব পূরণ করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে বহু চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীকে সরকারিভাবে নিয়োগের মাধ্যমে। এমনকি আশি ও নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু মালয়েশীয় শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতেন। অথচ মাত্র বছর পঁচিশেকের ব্যবধানে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে যান মালয়েশিয়ায়। সে দেশে স্থাপিত হয়েছে উন্নত দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস। বাংলাদেশ থেকে এখন আর দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন নেই দেশটির, বরং আমাদের অদক্ষ শ্রমিকেরা যেকোনো একটি কাজের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন বিপৎসংকুল সমুদ্র।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬৩ সালে যখন মালয়েশিয়ান ফেডারেশন গঠিত হয়, তখন কিন্তু সিঙ্গাপুরও এই ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য পরবর্তী সময়ে (১৯৬৫) সিঙ্গাপুর এই ফেডারেশন ছেড়ে এসে আলাদা সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সে সময় মালয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৩০৪ মার্কিন ডলারের সমান। মাত্র ৩০ বছরের মাথায় এই অঙ্ক চার হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের ২০ বছরের কম সময়ে এসে দেশটির মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলার পেরিয়ে গেছে। দেশটি যখন স্বাধীন হয়, সে সময় তাদের রপ্তানি নির্ভরশীল ছিল মূলত দুটি প্রাথমিক পণ্যের ওপর—রাবার ও টিন। বিশ্ববাজারে এগুলোর দাম ছিল অস্থির, তাই দেশটির রপ্তানি আয়ও ছিল অস্থিতিশীল।
স্বাধীনতার পর গুটিকয় প্রাথমিক পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য আরও কিছু পণ্য যেমন পাম তেল, কোকো ইত্যাদি যুক্ত হয় রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে। উন্নয়ন কৌশলের এই পন্থাটির (রপ্তানিনির্ভর) সঙ্গে গ্রহণ করা হয় অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য আমদানি বিকল্প নীতি, দেশজ উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় শুল্কসুবিধা। তবে আমদানি বিকল্প কৌশল দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাওয়া কার্যকর হয় না বিধায় সত্তরের দশকে এসে এই কৌশল পরিবর্তন করে আবার রপ্তানিনির্ভর কৌশল গ্রহণ করা হয়। নব্বইয়ের দশকে দেশটির মোট রপ্তানি বাণিজ্যে ৩০ শতাংশ শিল্পজাত পণ্য সংযোজিত হলে মালয়েশিয়া নবশিল্পায়িত দেশে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত গ্রোথ কমিশনের ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে মালয়েশিয়াকে বিশ্বের ১৩টি দেশের মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে ২৫ বছর ধরে গড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ মালয়েশিয়াকে তৃতীয় বিশ্বের একটি প্রদর্শনী মডেল হিসেবে গণ্য করে, যে দেশটি খুব স্বল্প সময়ে উন্নয়নশীল দেশ থেকে অগ্রসর দেশে পরিণত হতে পেরেছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, মালয়েশিয়ার এই ব্যতিক্রমী উন্নয়ন মডেলের সাফল্য কেবল দেশটির উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের কারণে নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা মুদ্রাস্ফীতিই ছিল মূল সাফল্য। ১৯৭০ সালেও দেশটিতে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৯ শতাংশ, পরবর্তী ২৫ বছরের মাথায় সেই হার নেমে এসেছে ৮ শতাংশে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয়বৈষম্যও কমে এসেছিল একই সময়ে।
বলা বাহুল্য, মালয়েশিয়ার এই দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন দেশটির দীর্ঘতম সময়ের (২২ বছর) প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। আশির দশকের প্রথম দিকে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি দেশটিতে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁর একচ্ছত্র শাসনের বিরুদ্ধে বহু সমালোচনা থাকলেও দেশটির উন্নয়নের জোয়ারে সেসব ধোপে টেকেনি। মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষের অধিকাংশ এখনো মাহাথিরের ভক্ত। যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বই যে একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে, সেটি প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মালয়েশিয়া সফরের সময় বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে কিছু গৎবাঁধা আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু তার নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা কর্মকৌশল ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। বর্তমানে মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ১৩ কোটি ডলারের পণ্য। এই ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আলোচনা হয়েছে। তবে কীভাবে এই ঘাটতি কমানো হবে, কেবল সরকারি শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে আদৌ বাণিজ্যঘাটতি কমানো সম্ভব কি না, যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এগিয়ে না আসে, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই।
এ লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সফরের কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ‘শো কেস’ বাংলাদেশ নামের একটি বাণিজ্য মেলার আয়োজন করেছিল কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারে। মেলায় কিছু বাংলাদেশি পণ্যের স্টল ছাড়াও কয়েকটি ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির উপস্থিতি ছিল। সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয়বারের মতো মালয়েশিয়ায় এ মেলার আয়োজন করে। মেলায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে দেশের অবকাঠামো ও বিনিয়োগ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনার ওপর দুটি পেপার উপস্থাপন করা হয়। এ মেলায় চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল কোনো ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতি। প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী উপস্থিত থাকার কথা মঞ্চের ব্যানারে ঘোষিত থাকলেও আয়োজকদের দুর্ভাগ্য, তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। আয়োজকদের সূত্রে আরও জানা যায়, তাঁরা বিনিয়োগ বোর্ড এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে অনুরোধ করেছিলেন বিনা ভাড়ায় স্টল নেওয়ার জন্য। তারা নাকি উল্টো উদ্যোক্তাদের কাছে যাতায়াত খরচ এবং হোটেল ভাড়াও দাবি করেছিল। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার জন্য একটি বেসরকারি সংগঠন যেখানে নানা মহলে ধরনা দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাহায্যে এ রকম একটি আয়োজন করতে পারে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এ রকম আচরণ বিস্ময়করই বটে।
সেমিনারের শেষভাগে প্রশ্নোত্তর পর্বে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে যেসব প্রশ্ন রাখা হয়, সেসব প্রশ্ন থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও পরিবেশ নিয়ে বিদেশিদের বহু ভুল ধারণা রয়েছে। অথচ তাঁদের সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিল বিনিয়োগ বোর্ডের। তাদের পক্ষে কেউ না থাকায় অগত্যা প্যানেল আলোচকেরাই প্রশ্নগুলোর জবাব দেন।
এ কথা বোধ করি কেউই অস্বীকার করবেন না যে বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যতটুকু শিল্পায়ন হয়েছে, কিংবা অন্যান্য খাতেও যে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, তা ঘটেছে মূলত বেসরকারি খাতের উদ্যোগে ও দক্ষতায়। উল্লেখ করা দরকার, মালয়েশিয়ায়ও একসময় সরকারি হস্তক্ষেপ এবং সরকারি বিনিয়োগ ছিল ব্যাপক, কিন্তু পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ অদক্ষ এবং লোকসানি প্রমাণিত হলে সেই ধারা কমে আসে। এমনকি সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নীতিমালাও তুলনামূলকভাবে কঠোর ছিল বলে বিদেশিদের পক্ষে সেসব পূর্বশর্ত পালন করা ছিল কঠিন। অথচ আমাদের দেশে বিনিয়োগ বোর্ডে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নামের কিছু একটা কাগুজে নামের অস্তিত্ব থাকলেও, বিদেশিদের জন্য অবারিত সুযোগের কথা বলা থাকলেও শিল্পকারখানা স্থাপনে সীমাহীন আমলাতান্ত্রিক হয়রানির অভিযোগ কোনোভাবেই মোচন করা সম্ভব হয়নি। বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রণোদনা নিশ্চিত করতে না পারলেও আমাদের বেসরকারি খাত তার নিজস্ব গতি ও আগ্রহে এগিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চিত করছে প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত মাত্রা। সরকারি প্রণোদনা ছাড়া বেসরকারি খাত যেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে, তার সঙ্গে যদি সত্যিকার অর্থে কার্যকর এবং নিরঙ্কুশ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যুক্ত হতো, তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার যে বর্তমান হার থেকে বেশি হতো, সেটি নিশ্চয়ই কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
[email protected]