বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার: আর্থিক ও কৌশলগত স্বার্থ যেখানে গুরুত্বপূর্ণ

>
কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট
কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট
প্রথমা প্রকাশন থেকে রোহিঙ্গা: নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী শিরোনামের একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বইটির লেখক মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক কনস্যুলেট প্রধান মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। সেই বইয়ের অংশবিশেষ, যেখানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার—এই দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক, স্বার্থ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে, তা প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তিন পর্বে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ রক্ষার্থে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডর বা ট্রানজিট পাওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ বিষয়টি বাণিজ্যিক ও পারস্পরিক লাভজনক একটি সমঝোতার ভিত্তিতে না দেখে রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার আলোকে বরাবরই বিবেচনা করেছে। বিষয়টি ২০০২ সালে আরও গুরুত্ব পায়, যখন ভারত রাখাইনে আবিষ্কৃত শোয়ে গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস নিতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পাইপলাইন নেওয়ার প্রস্তাব করে।

বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেক বৈঠক আর আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এ বিষয়ে তিন দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। এই সমঝোতায় এটাও উল্লেখ ছিল, প্রয়োজনে বাংলাদেশও এ পাইপলাইন থেকে গ্যাস সরবরাহ নিতে পারবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ এ সমঝোতা স্বাক্ষর থেকে সরে আসে। 

আমি তখন মিয়ানমারে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রেষণে নিযুক্ত। আমি একান্তভাবে চাইছিলাম সমঝোতাটি স্বাক্ষরিত হোক। যখন বুঝতে পারি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার বিষয়টি ভেস্তে যাচ্ছে, আমি তখন অনেকটা মরিয়া হয়ে আমাদের তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টির ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করি। তিনিও আমার মতো বিষয়টির প্রতি তাঁর সমর্থন প্রকাশ করেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। 

আমার কাছে তখনো মনে হয়েছে, আমরা একটা ভূকৌশলগত ঐতিহাসিক ভুলে পা দিয়েছি। সেই সময়ে আমাদের নীতিনির্ধারক এবং কৌশলপ্রণেতারা অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এই অদূরদর্শিতা আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও ভূকৌশলগত অবস্থানের ওপর নিশ্চিতভাবে এক দীর্ঘ নেতিবাচক প্রভাব বয়ে বেড়াবে। আজকের রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে ভারতের মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানো এবং আমাদের পাশে না দাঁড়ানোর বা নির্লিপ্ততা সেই ভূকৌশলগত ভুলের মাশুল বলেই মনে হয়। 

২০০২ সাল থেকে ভারতীয় কৌশলপ্রণেতারা বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার না করে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের পথের সন্ধান শুরু করে। তাদের সেই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফল কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট। এটি ভারতের কলকাতা বন্দরকে মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের সিটওয়ে (আকিয়াব) বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। সিটওয়ে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী। কালাদান সিটওয়েতে এসে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই কালাদান চিন স্টেট থেকে উত্পত্তি হয়ে কখনো চাল, কখনো বইনু, কখনো টোয়ে, অবশেষে মিজোরামে এসে কিসিপ্যা নাম ধারণ করে। কিসিপ্যা এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হলে তার সঙ্গে ক্রমে তুইচুঙ্গ, ম্যাট, কুরিতাংডেং ইত্যাদি নদীর প্রবাহ যোগ হয়ে কিসিপ্যাকে প্রবলভাবে প্রবহমান করে। কিসিপ্যা মিজোরাম থেকে পুনরায় চিন স্টেটে প্রবেশ করে রাখাইন স্টেটের চকউতো টাউনশিপের সিটওয়ের দিকে বিপুল জলরাশি আর প্রবল স্রোতে বয়ে চলে। সিটওয়ে এসে কিসিপ্যা বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। রোহিঙ্গাদের মতো হাজার বছর বয়ে চলা কিসিপ্যার ললাটেও জোটে অপবাদের তিলক-কিসিপ্যা বিদেশি। সেই অপবাদ-তিলকের নাম কালাদান। কালা অর্থ বার্মিজদের কাছে বিদেশি। যেহেতু অন্য দেশ থেকে এর প্রবাহ, সেহেতু কিসিপ্যার নাম হয়ে যায় কালাদান। 

সাগরপথে কলকাতা থেকে সিটওয়ের দূরত্ব ৫৩৯ কিলোমিটার। কলকাতা বন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ সিটওয়ে এসে পৌঁছানোর পর তা লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে কালাদান নদী হয়ে চিন স্টেটের প্লাটওয়া নৌবন্দরে পরিবহন করা হবে। এর ফলে এযাবত্কাল ভারত তার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে শিলিগুড়ি নেক হয়ে যে পথে পণ্য আনা-নেওয়া ও যাতায়াত করত, তার দূরত্ব বহু গুণ কমে আসবে। শিলিগুড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক সংকীর্ণ করিডর, যা ভারতকে তার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে স্থলপথে সংযুক্ত রেখেছে। শিলিগুড়ি চিকেন নেকের এক পাশে নেপাল আর অন্য পাশে বাংলাদেশ। 

সিটওয়ে বন্দর বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সিটওয়ে বন্দরকে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট চিন স্টেটের পাটওয়া নৌবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। পাটওয়া মিয়ানমারের সর্ব পশ্চিমাঞ্চলের চিন স্টেটের একটি শহর। এ শহরের দূরত্ব বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার। ইতিপূর্বে পাটওয়া আরাকানের অংশ ছিল, উ নুর শাসনামলে পাটওয়া চিন স্টেটের অংশ করা হয়। সিটওয়ে থেকে কালাদান নদীপথে পাটওয়ার দূরত্ব প্রায় ১৫৮ কিলোমিটার। পাটওয়া নদীবন্দর থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরত্বে ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত মিয়ানমারের জোরনিপুই। জোরনিপুই থেকে আইজলের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। আইজল থেকে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট সাইহা হয়ে মিজোরামের লংলাইতে ভারতীয় মহাসড়ক এনএইচ-৫৪-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আরও দূর এগিয়ে আসামের দাবাকাতে এসে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী পূর্ব-পশ্চিম করিডরের সঙ্গে মিশেছে। 

কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টে এ সড়ক যোগাযোগের বাইরে আরও যা রয়েছে: 

রেল যোগাযোগ: আসামের কাটাখাল থেকে মিজোরামের ভৈরবী-সিয়ারং-হামাংবুক্কু-জোযাচ্চু হয়ে পাটওয়া পর্যন্ত রেল যোগাযোগ। 

সিটওয়ে বিশেষ শিল্পাঞ্চল: কালাদানের উজানে সিটওয়ে থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে পুনাজ্জমে ভারত এ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলবে। 

সিটওয়ে-গয়া গ্যাস পাইপলাইন: ১ হাজার ৫৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পাইপলাইন সিটওয়ে-আইজল-শিলচর-গুয়াহাটি-শিলিগুড়ি হয়ে গয়া পৌঁছাবে। 

তাতে চুং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: এই প্রকল্পের অধীনে চিনদুইন নদীর থামানথি এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং শেওয়াজি এলাকায় আরেকটি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৬০০ মেগাওয়াট, মোট ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ ভারতের পূর্বাঞ্চলের মণিপুর রাজ্যে ব্যবহার করা হবে। 

ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় সড়ক পরিবহন: ভারত-মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী মণিপুরের মোরে শহর থেকে শুরু হয়ে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে থাইল্যান্ডের মায়ে সোট শহরে গিয়ে এই রাস্তা তিন দেশকে সংযুক্ত করবে। উল্লেখ্য, মায়ে শোট মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের স্থলবাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। এ প্রকল্পগুলো ছাড়াও ইন্ডিয়া-মিয়ানমার-জোকাথার-রি হাইওয়ে, প্লাটওয়া-চিক্কা-ইন্ডিয়া হাইওয়ে প্রজেক্ট, আইজল-থুইপাং ন্যাশনাল হাইওয়ে উল্লেখযোগ্য। 

কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট ভারতকে যেসব অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত সুবিধা অর্জনে সুযোগ দেবে, তার অন্যতম হলো: 

ক. ভারত তার ভূবেষ্টিত পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সহজ যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। 

খ. শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক হয়ে যাতায়াতের যে দূরত্ব ভারতকে এত দিন পাড়ি দিতে হয়েছে, তা থেকে অনেক কম দূরত্ব ভারতকে পাড়ি দিতে হবে। 

গ. পণ্য পরিবহনে কলকাতা-সিটওয়ে-মিজোরাম পথ ভারতের জন্য অনেক সাশ্রয়ী হবে। 

ঘ. শিলিগুড়ি বা চিকেন নেক থেকে নির্ভরতা কমিয়ে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগে ভারতকে নির্ভার করবে।

ঙ. থা শোয়ে গ্যাসফিল্ড থেকে ভারত নির্বিঘ্নে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে। 

চ. জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতে তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে। এ থেকে সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। 

ছ. চকপিউকে ভিত্তি করে চায়নার গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা এবং সেখান থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে তাদের গতিবিধির ওপর ভারত খুব সহজে চোখ রাখতে পারবে। 

জ. এ ক্ষেত্রে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন, সে তার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে সেই অঞ্চলের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে বিদ্যমান অসন্তোষ দূর করতে সক্ষম হবে। 

ঝ. মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগে মিয়ানমার থেকে ভারত তার প্রয়োজনীয় অনেক কাঁচামাল যেমন সংগ্রহ করতে পারবে, তেমনি মিয়ানমারে তার উৎপাদিত পণ্যও রপ্তানি করতে সক্ষম হবে। 

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিমধ্যে ভারত ও চীনের অবস্থান বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়েছে। দুটি দেশই তাদের অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত ভারত যা বিবেচনায় নিয়েছে: 

ক. তার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপন, যা ইতিমধ্যে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রজেক্টের মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে। 

খ. মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সেভেন সিস্টারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহী তৎপরতা দমন ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। ১৯৯৫ সালে ‘ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকান’-এর দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গেরিলা দলের বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জব্দ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই অভিযানে উলফা, পিএলএ ও এনসিএন (কে) গেরিলা গোষ্ঠীর ৫০ জন সদস্য নিহত হয়। ২০১৬ সালেও পারস্পরিক সম্মতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী নাগা গেরিলা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করে। 

গ. মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব খর্ব করার মরিয়া চেষ্টা। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ভারত থাম্মু-কালে¬-মান্দালয় সড়ক সংযোগও গড়ে তুলেছে। 

ঘ. মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। 

ঙ. রাখাইন অঞ্চলকে ভিত্তি করে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা এবং সহজ যাতায়াতের মাধ্যমে তা তার পূর্বাঞ্চলে সরবরাহ নিশ্চিত করা। 

চ. চীন তার ভূকৌশলগত স্বার্থে মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ভারতকে যেন বেকায়দায় ফেলতে না পারে, সে চেষ্টা। 

ছ. ভারত তার অ্যাক্ট ইস্ট নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী মণিপুরের মোরে শহর থেকে শুরু করে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে থাইল্যান্ডের মায়ে শোট শহর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করে তাতে তিন দেশকে সংযুক্ত করেছে। উল্লেখ্য, মায়ে শোট মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের স্থলবাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। 

জ. মিয়ানমারের বাজার দখল। 

ঝ. মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর চীনের প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা। এ প্রসঙ্গে ৫-৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মিয়ানমার সফরকালীন নেপিডোতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য এখানে উল্লেখ্য। তিনি বলেন, ‘রাখাইন স্টেটে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে নির্দোষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণের মতো ঘটনার বিরুদ্ধে ভারত আপনাদের পাশে আছে।’ এর প্রত্যুত্তরে অং সান সু চি বলেন, ‘আমাদের দেশের ওপর সন্ত্রাসী হুমকির বিরুদ্ধে ভারতের জোরালো সমর্থনের জন্য আমরা ভারতকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ 

ভারত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার কৌশল পরিবর্তনে ব্রতী হয়েছে। মিয়ানমার ভারতকে আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করার দ্বার। কারণ, মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের রয়েছে জল ও স্থলসীমান্ত, যা ভারতকে আসিয়ানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ অবারিত করতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ৫-৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মিয়ানমার সফর করেন। তাঁর এই সফরের অব্যবহিত আগে মিয়ানমার তার রাখাইন স্টেটে সন্ত্রাস দমনের নামে চার শতাধিক নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা এবং জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দুই লাখ মানুষকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিঃসম্বল অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করে। 

ভারত-মিয়ানমারের এই পারস্পরিক সমর্থন ও সৌহার্দ্যের পেছনে রয়েছে পারস্পরিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। তবে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামের ভাষায় ‘নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমারের প্রতি এ অকুণ্ঠ সমর্থন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশকে এক অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয়।’ 

একসময়ের ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পি এন হাকসারের মেয়ে নন্দিতা হাকসারের বই রুজ এজেন্ট-এ বর্ণিত নিচের লাইন দুটিই মিয়ানমারের ব্যাপারে ভারতীয় অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য যথেষ্ট:

‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ভারতের সমর্থনদানের উদ্দেশ্য একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর চীনের প্রভাব খর্ব করা, অন্যদিকে আরাকানে প্রাপ্ত গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস পাওয়া নিশ্চিত করা।’ 

বলা বাহুল্য, ভারত তাদের শিলিগুড়ি নেক ব্যবহার করে রাখাইন অঞ্চল থেকে গ্যাস-সুবিধা গ্রহণ করছে। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে ভারত রাখাইনের সিটওয়ে বন্দর থেকে কালাদান নদীর মাধ্যমে মিজোরামের আইজল পর্যন্ত নৌপথ চালুর সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিটের ঝক্কিঝামেলা বাদ দিয়ে সহজে তাদের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা।

আগামীকাল: হুমকির মুখে আঞ্চলিক নিরাপত্তা 

মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক কনস্যুলেট প্রধান