বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সংকট

এঁদের সবার উচ্চশিক্ষার সুযোগ রাষ্ট্র দিতে পারবে কি?
এঁদের সবার উচ্চশিক্ষার সুযোগ রাষ্ট্র দিতে পারবে কি?

‘ভর্তিযুদ্ধ’ শব্দটি একান্তভাবে আমাদের। শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তির যুদ্ধ। অন্যান্য দেশে অনেক কিছু নিয়ে যুদ্ধ হলেও এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যুদ্ধ তেমনটি কোথাও হতে দেখা যায় না। শিক্ষালাভের জন্য যুদ্ধ নিঃসন্দেহে একটি ভালো যুদ্ধ, তবে এটি হওয়ার কথা ছিল না। শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চাহিদা আর জোগানের মধ্যে তফাত বিশাল। প্রতিবছর অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের পছন্দমতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য এই ভর্তিযুদ্ধটা শুরু করেন। যুদ্ধের মাত্রাটা বেড়ে যায়, কারণ সবাই তাঁদের সন্তানদের ‘পছন্দসই’ স্কুলে ভর্তি করাতে চান। এই ‘পছন্দসই’ স্কুলের ধারণাটাও একান্তভাবে আমাদের। কারণ, সব বিদ্যালয়ের মান বা সুযোগ-সুবিধা সমান না হলেও মানসম্মত ও ‘পছন্দসই’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ দেশে সর্বক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান যেহেতু সমান নয় এবং এ কারণেই অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে সব সময় তৎপর থাকেন।
এককালে যেসব স্কুল খুবই উন্নত মানের ছিল, সেসব স্কুলের নাম বর্তমানে তেমন একটা শোনা যায় না। আবার গত দুই দশকে শহরকেন্দ্রিক বেসরকারি পর্যায়ে অনেক স্কুল বা অন্যান্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার কিছু উন্নত মানের। তবে সেখানে ভর্তি করানো বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। কারণ, এসব স্কুল কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা পায় না অথবা নেয় না, অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বাণিজ্যও করে। যখন এসব বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য শিশুরা যুদ্ধে লিপ্ত, তখন দেখা যায় অনেক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী স্কুলের অধিকাংশ আসনই খালি থেকে যাচ্ছে এবং এসব স্কুলের অধিকাংশই সরকারি। এই অবস্থার জন্য প্রথমেই সরকারকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, এই স্কুলগুলোকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে বিভিন্ন সময়ে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আবার যখন এই শিক্ষার্থীরা একদিন এসএসসি অথবা সমমানের পরীক্ষা পাস করবে, ঠিক একই সমস্যার সম্মুখীন হবে, যখন তারা তাদের ‘পছন্দসই’ কলেজে ভর্তি হতে যাবে। কারণ, এই ‘পছন্দসই’ কলেজের ধারণক্ষমতা আরও সীমিত।
কয়েক দিন আগে দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি অথবা সমমান পরীক্ষার ফল প্রকশিত হলো। এবার এই পরীক্ষায় সব বোর্ড মিলিয়ে মোট আট লাখ ÿ৮৫ হাজার শিক্ষার্থী পাস করেছেন, শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি। এই পাস করা শিক্ষার্থীরা এখন আরেক ভর্তিযুদ্ধে লিপ্ত হবেন। যাঁরা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেছেন, তাঁরা চাইবেন মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। যাঁরা অন্যান্য বিভাগ থেকে পাস করেছেন, তাঁদের দৃষ্টি থাকবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। এখানেও আবার কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা যাবে। যেমন সবার দৃষ্টি থাকবে দেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। কারণ, এগুলোর অবকাঠামোগত ও পঠন-পাঠনের সুযোগ-সুবিধা উন্নত মানের। অভিজ্ঞ শিক্ষক আর সুনাম অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স এবং সুনামও বেশি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চাইবেন, তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভর্তি হতে পারবেন, অন্যরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ এখনো একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও একাধিক ভালো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে দেশে। কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেমন চাপ পড়বে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটে তেমন একটা চাপ পড়বে না। কারণ, এখনো বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা এই বিষয়টাকে তাঁদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখেননি।
এখন বড় প্রশ্ন, এই যে এত শিক্ষার্থী এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তাঁদের পরবর্তী গন্তব্য কোথায়? বেশির ভাগই তাঁদের পছন্দসই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও বিরাট সংখ্যককে ব্যর্থ হতে হবে। কারণ, পর্যাপ্ত আসন নেই। প্রথমে ধরা যাক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা। দেশে বর্তমানে ৩৪টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক ৩৭ হাজার আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৯৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে যে এসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ সমান হবে না। কারণ, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো শিক্ষক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রচণ্ড অভাব। এর একটি প্রধান কারণ, ভালো ছাত্রছাত্রীরা এখন আর শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। কারণ, একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসুলভ জীবন ধারণের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংকট প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক গুরুতর কোনো অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁর চিকিৎসার জন্য শিক্ষকদের চাঁদা তুলতে হয়।
বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স মাত্র ২২ বছর। এই ২২ বছরে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও অধিকাংশই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ, যাঁরা এসব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য সব সময় মহৎ ছিল না। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তাঁরা তাঁদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ জ্ঞান বিতরণের চেয়ে বাণিজ্য করাই প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়েছেন। এর ফলে এসব ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানলাভে ব্যর্থ হবেন এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত হবেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনেক চেষ্টা করেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কারণ, মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতা সীমিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশনকে কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে 

ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেও থমকে যেতে হয়েছে। কারণ, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নিতে সক্ষম হয়েছে। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন জনগণের অর্থে চলে বলে সেখানে পড়ালেখা অনেকটা নিঃখরচায় করা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা সম্ভব নয়। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর ভিত্তি করে। এদের আবার সরকার থেকে সেবা কিনতে হয় বাণিজ্যিক হারে। দিতে হয় চড়া আয়কর। এসবের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনের খরচ অনেক বেশি এবং তা অনেক অভিভাবকের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।

এর বাইরে আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুই হাজার সাতটি ডিগ্রি কলেজ, যেখানে তিন লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। আছে ডেন্টাল কলেজ, পলিটেকনিক, কিছু বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট। সব মিলিয় উচ্চশিক্ষার জন্য দেশে প্রাপ্ত আসনসংখ্যা আনুমানিক সাত লাখ ৪৫ হাজার। ভর্তি হতে পারবেন না প্রায় পৌনে দুই লাখ শিক্ষার্থী। অনেকে সংগতি থাকলে পাড়ি জমাবেন বিদেশে এবং একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতারিতও হবেন। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সরকারকেই প্রথমত এগিয়ে আসতে হবে। সর্বস্তরের শিক্ষাক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের জন্য তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে বহুগুণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি অনেক দিনের। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতন সার্ক দেশগুলোর মধ্যেও সর্বনিম্ন। আওয়ামী লীগকে সব সময় একটি শিক্ষাবান্ধব দল হিসেবে দেখা হয়। তাই এই কাজটি এই সরকারের আমলে না হলে অন্য কোনো সরকারের আমলে হবে, তা মনে হয় না। সরকারি হোক অথবা বেসরকারি, এই মুহূর্তে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি না দিয়ে বরং যেগুলো চালু আছে, সেগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য। প্রয়োজনে যেসব অভিজ্ঞ শিক্ষক বর্তমানে অবসরে আছেন, তাঁদের বিশেষ ব্যবস্থায় পুনরায় নিয়োগ করার কথা চিন্তা করতে হবে। এমন ব্যবস্থা ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই করা হয়ে থাকে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ আছে, সেখানে দুই শিফট চালু করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের ডিগ্রি কলেজগুলোর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। অধিকাংশ কলেজে না আছে ভালো শিক্ষক অথবা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, না আছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যখন করা হয়েছিল, তখন ডিগ্রি কলেজের সংখ্যা ছিল ৫০০। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে চার গুণের বেশি হয়েছে। বর্তমান কাঠামোতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এত কলেজ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পুনরায় বিচার-বিশ্লেষণ করার সময় হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্তমান চাপ থেকে কিছুটা মুক্ত করতে পুনরায় ঢাকা, রাজশাহী আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তাদের আগের নিয়ন্ত্রণের এলাকায় যেসব কলেজ ছিল, সেই এলাকার কলেজগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর খবরদারির প্রয়োজন যেমন আছে, ঠিক তেমনি প্রয়োজন আছে সহায়তা। শিক্ষার চেয়ে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আর কোনো ভালো ক্ষেত্র হতে পারে না। সব সরকারই অনেক অনুৎপাদনশীল খাতে অনেক অর্থ ব্যয় করে। সেই ব্যয় কমিয়ে তা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করলে লাভ হবে দেশের। শিক্ষায় যে ব্যয়টা হয়, তা খরচ নয়, এটি জনসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ। জনসম্পদের চেয়ে বড় সম্পদ কোনো দেশের জন্যই আর কিছু হতে পারে না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।