বাংলাদেশে কারও কোনো স্বার্থ নেই?

রোহিঙ্গা সমস্যার আলোচনা এখন ভাসানচরকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের একটি অংশকে সেখানে নেওয়া উচিত কি উচিত নয়, সেই আলোচনাই এখন আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে। অথচ তাদের যে নিজের ভূমি আরাকানে ফেরাতে হবে, সেই জরুরি প্রসঙ্গ থেকে আমরা যেন দূরে সরে যাচ্ছি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আমাদের চেষ্টা ও উদ্যোগ সফল হয়নি এবং হচ্ছে না, কারণ মিয়ানমার তাদের ফেরত নিতে চায় না। এ অবস্থায় আমাদের কী করা উচিত? এ নিয়ে বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের যত লেখালেখি পড়েছি তাতে একটাই উত্তর মিলছে; কূটনৈতিক উদ্যোগ। সেখানে আমরা আসলে কতটা কী করতে পারছি?

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। সরকার সেই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কিছুটা হলেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ যদি হয় ‘কূটনৈতিক উদ্যোগ’, সেখানে আমরা দেখলাম ভাসানচর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হলো।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সময়মতো ও যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের অবস্থানকে যথাযথভাবে তুলে ধরাও কূটনীতির কাজ, সেখানেও সম্ভবত আমাদের ঘাটতি রয়েছে। তা না হলে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বা অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় মিয়ানমার যে গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বাংলাদেশ পাবে না কেন?

কআন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটা সবারই জানা যে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টির কোনো দায় বাংলাদেশের নেই এবং এই সমস্যা বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে এবং বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে। এই দুটি বিষয়ই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রশংসা ও সহানুভূতি পাওয়া ছাড়া এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো কার্যকর সমর্থন আদায় করতে পারছে না।

দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ হিসেবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করেছে এবং সে কারণেই স্বেচ্ছায় তারা রোহিঙ্গাদের আবার ফিরিয়ে নেবে, এমন আশা করার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্য না হলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। একমাত্র আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমেই মিয়ানমারকে বাধ্য করা সম্ভব। এই কাজটিতেই আমাদের কূটনীতি এখনো সফলতা দেখাতে পারছে না।

পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতির সমালোচনা করলেও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের তেমন অস্ত্র তাদের হাতে নেই। আমরা যে আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলছি, সেখানে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে যে দুটি দেশ সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, সেই দেশ দুটি হচ্ছে ভারত ও চীন। এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে দেশ দুটি শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়, তাদের বৈরিতাও দৃশ্যমান। এই দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ এবং ভারসাম্যপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এর কৃতিত্ব বাংলাদেশের কূটনীতি নিতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এই দেশ দুটির একটিকেও কাছে টানতে পারেনি। দেশ দুটি পরিষ্কারভাবেই মিয়ানমারের দিকে হেলে আছে।

গত ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়, সেখানেও চীন ও ভারত তাদের অবস্থান আবার স্পষ্ট করেছে। ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক এই প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেয় চীন। আর ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ভারত। এই তালিকায় নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশীয় দেশ এবং বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু দেশ জাপানও রয়েছে। চীনের মতো রাশিয়াও বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।

মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের মতো দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের অবস্থান এক হওয়ার পেছনে কী কাজ করছে, এমন প্রশ্নের একধরনের জবাব অনেক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকের লেখায় পেয়েছি। তাঁরা বলতে চান, ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, কৌশলগত কারণ ও বাণিজ্যিক স্বার্থে ভারত ও চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় ভারত ও চীনের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে, সেটা আমাদের জানা। সেই বিবেচনায় মিয়ানমারকে দুই দেশই কাছে পেতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীন তার ভূকৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। সেখানে মিয়ানমার চীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। মিয়ানমারে যে দেশটির বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি, সেই দেশটি চীন। ভারতও মিয়ানমারকে ঘিরে তার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে আরাকান রাজ্যের সিটওয়ে বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করা, সেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা, আরাকান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস নেওয়া বা জলবিদ্যুতের মতো বড় বড় প্রকল্পে ভারত বিনিয়োগ করছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে।

ভারত ও চীন তাদের নিজ নিজ ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। এসব স্বার্থের কাছে মিয়ানমারের জাতিগত শোধনের উদ্যোগ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ গৌণ হয়ে যাবে, সেটাও হয়তো বাস্তবতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারে দেশ দুটির ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, বাংলাদেশে তাদের কোনো স্বার্থ নেই? মিয়ানমারকে যেকোনো মূল্যে হাতে রাখা এই দেশ দুটির জন্য জরুরি, কিন্তু বাংলাদেশকে নয়? নাকি বাংলাদেশ তার গুরুত্বকে এই দেশ দুটির কাছে ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মর্যাদা যা–ই হোক, তারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে না চাইলে বাংলাদেশের পক্ষে কিছু করা কঠিন। রোহিঙ্গারা তখনই মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে ফিরে যেতে চাইবে, যদি তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায়। আমাদের মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট দূর করতে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেখানে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি, সে রকম কিছুর নিশ্চয়তা বা আন্তর্জাতিক কোনো গ্যারান্টি ছাড়াই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই করেছে। সিদ্ধান্ত হিসেবে তা যে সঠিক ছিল না, তা আজ প্রমাণিত। এখন এ বছরের আগস্টে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব নতুন করে আন্তর্জাতিক তদারকিতে আরাকান রাজ্যে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন।

বোঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সময়মতো ও যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের অবস্থানকে যথাযথভাবে তুলে ধরাও কূটনীতির কাজ, সেখানেও সম্ভবত আমাদের ঘাটতি রয়েছে। তা না হলে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বা অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় মিয়ানমার যে গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বাংলাদেশ পাবে না কেন?

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]