বাংলাদেশে স্বাভাবিকই কি নতুন স্বাভাবিক

নরমাল ইজ দ্য নিউ নরমাল। বাংলাদেশে এখন সবকিছু ২০২০ সালের মার্চের আগের মতোই, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধ থাকা ছাড়া। আগস্ট পর্যন্ত আমি ঘর থেকে বের হইনি। ভাবতাম, দেশের মানুষও নিশ্চয়ই ঘর থেকে বের হন না। সেপ্টেম্বরে বেরোনো শুরু করে মনে হলো, আমি ছাড়া বোধ হয় সবাই বাইরে বেরিয়ে পড়েছেন। রাস্তায় ভিড়। বাজারে গিজগিজ করছে মানুষ। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে সৌদি আরবগামী মানুষের হাট, বিক্ষোভ, সমাবেশ। কক্সবাজারের কোনো হোটেলে ছুটির দিনে সিট নেই, এমনকি দেশের অন্য রিসোর্টগুলোতেও ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই, ছোট এ রিসোর্ট অবস্থা। ঢাকার বাইরে আগে থেকেই করোনা-বিষয়ক শঙ্কা কম ছিল, সাবধানতাও তেমন চোখে পড়ত না। নিজেই ঢাকার বাইরে যাওয়া শুরু করলাম।

একদিন দেখতে গেলাম পদ্মা সেতু, আরেক দিন গেলাম ঘোড়াশালের গ্রামে। পারিবারিক কাজে গিয়েছিলাম গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ভূমি নিবন্ধন দপ্তরে। মানুষ আর মানুষ। আদালতের লিফটের সামনে ৫০০ মানুষ, সিঁড়িতে মানুষের ঢল নিচে নামছে, তাকে বাধা দিয়ে মানুষের জোয়ার ওপর উঠতে চাইছে। আপনাকে উঠতে হলে কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে গুঁতো মেরে উঠতে হবে। মনে হবে, আপনি বৈশাখী মেলা ভাঙার সময় উল্টো স্রোত ঠেলে মেলার ভেতরে ঢুকতে চাইছেন।

কোভিড–১৯ সংক্রমণ কিংবা বিপদ কিন্তু কমেনি। ২১ অক্টোবরেও সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এ রোগে মারা গেছেন ২৪ জন, নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৪৫ জন। মহামারি যায়নি, তবে এর ভয় মানুষের মন থেকে কমে গেছে।

এ কথা ঠিক যে আমেরিকা ও ইউরোপের তুলনায় বাংলাদেশে কোভিডের ভয়াবহতা কম। এর মধ্যে জানা গেল, ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষের করোনা সংক্রমণ ঘটে গেছে। অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ফলাফল বলছে, তিন মাস আগেই রাজধানীর ৪৫ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ঢাকার বস্তিবাসীর চারজনের তিনজনের মধ্যে করোনা সংক্রমণ এরই মধ্যে ঘটে গেছে। তা হয়ে থাকলে কোভিডে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার আসলেই কম।

ছোট আকারের এই গবেষণাও তিন মাস আগের, এরই মধ্যে যদি ঢাকা শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষের দেহে করোনার সংক্রমণ ঘটে থাকে এবং এঁদের দেহে রোগপ্রতিরোধক উপাদান রয়ে যায়, তাহলে কি আমরা হার্ড ইমিউনিটির দিকে যাচ্ছি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কথা বলা যাবে না। কারণ, আসলে করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমরা জানি কম। তার ওপর করোনার রোগপ্রতিরোধক উপাদান শরীরে কত দিন থাকে, মানুষ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত আসলেই হয় নাকি হয় না, এসব বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কেউই কিছু বলতে পারেন না। আমেরিকা ও ইউরোপে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের বিস্তার ঘটছে। শীতে এমনিতেই শ্বাসজনিত রোগ বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়, এটা কোভিড–১৯ আসার আগের চিত্র। মানে, প্রতিদিন প্রায় ১৩৭ জন শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়। ফলে আসন্ন শীতে করোনার দ্বিতীয় আঘাতের জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদম ঠিক কথাটা বলেছেন—হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে তিনি সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দেন। আমাদের দেশের বাতাসের মান খুব খারাপ, তার ওপর শীতকালে ধুলাবালু এবং ধোঁয়া বাড়বে। ফলে ঘরের বাইরে বেরোনোর সময়ে মাস্ক পরে থাকা আমাদের উপকারই দেবে।

তবে শীতকালটা পেরোলেই কোভিডের বিপদ থেকে আমরা অনেকটাই মুক্তি পাব, এই আশা বেশ জোরেশোরেই বুকে এসে বল দিচ্ছে। আর মাস তিনেক পরে হয়তো ঢাকার ৭০ ভাগ মানুষই করোনা পজিটিভ হয়ে যাবে, তারপর এর প্রকোপ কমে যাওয়া উচিত। সমস্যা হলো, ঢাকার বাইরে বহু জায়গায় এখনো করোনাভাইরাস যায়নি বললেই চলে। তাই ঢাকার বাইরে সংক্রমণ ঘটতেই থাকবে। আর সুবিধা হলো যেকোনো কারণেই হোক, বস্তিবাসী, খেটে খাওয়া মানুষ, গরিব মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সুবিধা করতে পারেনি। কারণ কী? আবারও একই উত্তর। এ তো নতুন একটা ভাইরাস, সবটা তো বিজ্ঞানীরা জানেন না। বোস্টন গবেষণায় বলা হয়েছে, ভিটামিন ডি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে, সেটাও হয়তো একটা কারণ হতে পারে।

করোনাভাইরাস আমাদের বহু নির্জলা সত্যের মুখোমুখি করেছে। পৃথিবী জেনে গেছে, আমেরিকার মতো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা মোটেও ভালো নয়। বিশ্ব মোড়লেরা নিজেদের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারেননি, কিন্তু হাজার মাইল দূরের কোটি মানুষকে মারার জন্য নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়ে রেখেছেন। পৃথিবীর বেশির ভাগ সম্পদ অল্প কজন মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত। আর বাংলাদেশে আমরা জেনে গেছি, আমাদের স্বাস্থ্য খাত কত বিশৃঙ্খল, দুর্নীতি কত ব্যাপক, অব্যবস্থা কত প্রকট।

কিন্তু এর মধ্যে ভালো দিক হলো দেশের মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলা করার ক্ষমতা। সরকারও কতগুলো ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সঠিক সময়ে কলকারখানা চালু করেছে। বাস-ট্রেনও চালু হয়েছে সময় থাকতেই। কৃষকেরা-শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেননি। প্রবাসী শ্রমিকেরা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে ডলার পাঠাচ্ছেন। ফলে অর্থনীতির নানা সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নতুন রেকর্ড করেছে। আইএমএফ বলছে, সামনের বছর মাথাপিছু বার্ষিক আয়ে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যাবে ভারতকে। এই নিয়ে ভারতের ভাষ্যকারদের মাথা এবং মাইক্রোফোন গরম হয়ে উঠেছে।

রসিকজন কৌতুক করে বলছেন, করোনার ভয় উঠে গেলেই বাংলাদেশিরা বিয়ের কেনাকাটা করতে আর চিকিৎসা নিতে ভারতে যাবে, তখন ভারতের অর্থনীতি আবার চাঙা হয়ে যাবে।

কৌতুক থাক। আসলে সূচক দিয়ে কোনো কিছু হয় না, আবার হয়ও। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি, শিশুমৃত্যুর হার কম, শৌচাগার ব্যবহার বেশি—এসব যেমন সত্য, তেমনি সত্য আমাদের দেশে এক মাইল রাস্তা নির্মাণে পৃথিবীর মধ্যে খরচ হয় সবচেয়ে বেশি। দুর্নীতিতে আমাদের হারানো কঠিন হবে। দুর্নীতিতে ভালোর তালিকায় ভারত ৮০, বাংলাদেশ ১৪৬। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সপ্তম। আফগানিস্তান ছাড়া সবাই আমাদের চেয়ে ভালো।

তবে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত উন্নয়নের সুফল প্রত্যেক মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ওপর। বৈষম্য যেন কম থাকে। ১০০ মানুষ লাখ কোটি টাকা দখল করে ১৬ কোটি মানুষকে নিঃস্ব করে রাখলেও কিন্তু মাথাপিছু আয় বেশি দেখাবে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, মানুষের কাজে লাগে এমন উন্নয়নই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার।

করোনাকালে বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক, সেখানে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। এই ইতিবাচকতাকে ১৬ কোটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়ে মুজিব বর্ষ থেকে আমরা এগিয়ে যাব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিকে। বাংলাদেশে ৫ ভাগ মানুষের কাছে দেশের ৯৫ ভাগ সম্পদ। বাংলাদেশ পৃথিবীর ১ নম্বর কোটিপতি উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমানোর কষ্টার্জিত সাফল্য করোনাকালে বিপর্যস্ত লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমা এবং চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে যাওয়ার শঙ্কার মুখে। বহু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং হারাচ্ছেন।

দেশে মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জিডিপি বাড়ছে—এই সুখবরগুলোকে সারা দেশের সব এলাকার সর্বস্তরের মানুষের ঘরে সুফল হিসেবে পৌঁছে দিতে পারতে হবে।

শেষ করার আগে বলতে চাই, মাস্ক পরুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। করোনার বিপদ কিন্তু যায়নি।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক