বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে বিশ্ব অর্থনীতি কেমন ছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুই–আড়াই দশক, অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিশ্বের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুবর্ণ যুগ হিসেবে পরিচিত। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পশ্চিম ইউরোপীয় এবং পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে অস্বাভাবিক উচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘটে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়। দুই পরাশক্তির অনুগামী দেশগুলোতে শর্তসাপেক্ষ সাহায্যের বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে শিল্পায়িত দেশসহ উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়।

রাশিয়ার সম্মতিতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত গোপন ষড়যন্ত্র চুক্তি ‘সাইকস-পিকট’-এর মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে মধ্যপ্রাচ্যে বহু জাতি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রাষ্ট্র হয় সোভিয়েত, নয় মার্কিন সাহায্য-সহযোগিতায় টিকে ছিল। বিশ্ব অর্থনীতি মোটা দাগে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক— এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়েছিল। দুই বিপরীত ধারার অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল স্নায়ুযুদ্ধকালীন প্রতিযোগিতার প্রধানতম অনুষঙ্গ ছিল।

কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শুরুতেই সংকট সৃষ্টি হয়। দীর্ঘমেয়াদি উত্থানের কাল ১৯৭৩-৭৫ মন্দার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ১৯৭০-এর দশকের গোড়া ও মাঝের দিকের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার সঙ্গে এর সরাসরি সংযোগ রয়েছে।

যেমন, এক. ১৯৭১ সালে ব্রেটন উডস আর্থিক ব্যবস্থার পতন; দুই. ব্রেটন উডস আর্থিক ব্যবস্থা ধসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ‘গোল্ডেন উইন্ডো’ বন্ধ হওয়া (নিক্সন শক)। এতে মার্কিন ডলার ছাপানোর সঙ্গে স্বর্ণের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক যোগসূত্রটি ছিন্ন করে ফেডারেল রিজার্ভকে আগের চেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতিমূলক অর্থ ব্যবস্থায় রূপান্তর করা হয়; তিন. ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক তেলসংকট; চার. ১৯৭৩-৭৪ সালের শেয়ার ধস ও মন্দা। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আরেক দিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ১৯৬৫ সালে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ শতাংশ, ১৯৭৫ সালে তা দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। ১৯৭১ সালে মার্কিন বাণিজ্যে প্রায় ২.৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হয়েছিল। ঘাটতি কমাতে নিক্সন ১৯৭১ সালে ডলার অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা দারিদ্র্য বিমোচনকে বিশ্বের অন্যতম বড় দায়িত্ব বলে স্বীকৃতি দেন। তার আগে ১৯৬১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি চালু হয়। এসবের ফলে দারিদ্র্যরেখার ধারণা, বিশ্ব ক্ষুধার সূচক, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, গুরুত্বপূর্ণ সূচক প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশগুলো নিজেদের নাগরিকদের নিঃস্ব চেহারা আয়নায় দেখতে শুরু করে

ইতিহাসবিদেরা ১৯৭০-এর দশককে বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসের অন্যতম বড় ‘পরিবর্তনের বাঁক’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। ১৯৭৩ সালে চিলির সালভাদোর আয়েন্দের নির্বাচিত বামপন্থী সরকারকে সিআইএ ক্যু-এর মাধ্যমে উৎখাত করলে সে দেশে জেনারেল অগাস্তো পিনোশের সেনাশাসন কায়েম হয়। চিলিতেই প্রথম অর্থনীতিবিদ এফ এ হায়েক, তাঁর শিষ্য মিল্টন ফ্রিডম্যানসহ ‘শিকাগো বয়েজ’ নামে পরিচিত অর্থনীতিবিদেরা নিও-লিবেরালিজম নামের নতুন অর্থনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তাঁরা দাবি করেন, এতে চিলির অর্থনীতির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে।

এরপর কেনসিয়ান প্রগতিশীল উদারবাদী তত্ত্বকে (কিছুটা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি) বেসরকারিকরণের একমুখী নয়া উদারবাদী তত্ত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রবণতা শুরু হয়। এই সব কারণে ১৯৭১-৭৫ বিশ্ব অর্থনীতির বাঁক পরিবর্তনের কাল হিসেবে স্বীকৃত।

সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দর্শন বাংলাদেশের প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে কখনোই সফল বাস্তবতা হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। মৌলিক নাগরিক সেবায় রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ জোরদার করার উদ্যোগ বেসরকারিকরণের পুঁজিবাদী কাঠামোর ভেতরে থেকেই দায়সারাভাবে চলতে থাকে। পর্যাপ্তসংখ্যক স্বাধীন ও সক্ষম প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি বলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা সেবাগুলো সাধারণ নাগরিকের প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে।

১৯৭৫-৭৬-এর পরে সাময়িকভাবে মন্দা কেটে গেলেও ১৯৮০-৮১ সালে বিশ্বব্যাপী বহু দেশ আবারও অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তীব্রভাবে হ্রাস পায়, বেকারত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো বড় অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত দ্রুত মন্দা থেকে মুক্ত হলেও অনেক দেশে ১৯৮৩ সালেও মন্দা ছিল। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকের মন্দা, লাতিন দেশগুলোর ‘ঋণ সংকটে’ আরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এ সময় আর্থিক সংকটে পড়ে বহু দেশ বিশ্বব্যাংকের ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। ক্যারিবিয়ান ও সাব সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতেও দীর্ঘস্থায়ী মন্দা ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৬০-৮০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আমেরিকাসহ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত অনেক দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এসবের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরীক্ষামূলক উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি কৌশল চাপিয়ে দেয়। দেশগুলো গভীর অর্থনৈতিক সংকট ও বাণিজ্য বৈষম্যে পতিত হয়। উত্তরণের পথ হিসেবে ১৯৮৯ সালে মার্কিন অর্থনীতিবিদ জন উইলিয়ামসন সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ১০ সেট বিস্তৃত সুপারিশমালা প্রস্তাব করেন, যা ‘পোস্ট ওয়াশিংটন কন্সেন্সাস’ নামে পরিচিত। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রণীত এসব পরামর্শ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ প্রয়োজনীয় বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে থাকলে নিওলিবারেল ধারণাগুলো প্রতিষ্ঠিত করার তৎপরতা চলতে থাকে। কিন্তু যখন অর্থনীতি সংকটে পড়ে, তখন কিছুটা সংস্কার, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আর অধিক নাগরিক সেবা ও সুরক্ষার সাময়িক আওয়াজ ওঠে।

বিশ্বায়নের নামে মানুষ, রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতিকে একীভূত করে বিশ্ব পুঁজি নতুন ক্ষমতাকাঠামোর জন্ম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হয়ে ব্যাপকতর বৈষম্যে পড়েছে। জন্ম নিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, আত্মপরিচয়ের সংকট, ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিস্তার, স্থানীয় সংস্কৃতির উচ্ছেদ। অর্থাৎ নয়া উদারবাদী, আধুনিকায়ন তত্ত্ব দেশে দেশে উন্নয়ন দর্শনের ছোট-বড় ক্ষত তৈরি করেছে। ফলে চার দশক পরে এসে নয়া উদারনীতিবাদের উত্থান ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নব্য উদারনীতিবাদের সঙ্গে কোভিড-১৯জনিত মন্দা যোগ হয়েছে। মহামারির ফলে বোঝা যাচ্ছে, নব্য উদারনীতিবাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।

২০০৭-০৮ সালের মার্কিন মন্দা এবং ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২০-এর করোনাকাল পর্যন্ত সময়ে নয়া উদারবাদের নেতিবাচক দিকগুলো সারা বিশ্বে অনেক ভালোভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে। বরং যেসব দেশে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় খাতের শক্তিশালী সংযোগ ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া রয়েছে, সেসব দেশ করোনা–উদ্ভূত সংকটকে চরম পুঁজিবাদী দেশগুলোর চেয়ে বেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করছে (চীন, ভিয়েতনাম, পশ্চিম ইউরোপ ইত্যাদি)।

বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মডেল নিয়ে কাজ করছে দেশগুলো যেখানে নয় উদারবাদের লাগাম টেনে রাষ্ট্রকে অধিক পরিমাণে সামাজিক সুরক্ষার দিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা ফেরাতে এবং পরিবেশ সুরক্ষার দিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে দেশে জনতুষ্টিবাদী সরকারের উত্থানে টেকসই উন্নয়ন প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন খামখেয়ালিপূর্ণ থেকে গেছে। একদিকে পরিবেশ বিপর্যয়, অন্যদিকে ধনবৈষম্য বাড়ার প্রবণতা থামানো যাচ্ছে না।

দুই
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটি সংকটময় ক্রান্তিকালে স্বাধীন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সমসাময়িক কালেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতির একটি দীর্ঘ সুবর্ণ যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিও সংকটে পড়ে কিছুটা প্রগতিশীল রূপ নেয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক মধ্য ধারার উদার ও মানবিক রাষ্ট্রীয় দর্শন শুরুতেই বিভাজিত দুই মেরুর বিশ্বে পরাশক্তিদের আস্থার টানাপোড়েন উপলব্ধি করে।

স্নায়ুযুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাফল্য অর্জনে কৌশলগত ভূমিকা রাখলেও সাবেক পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক পট পরিবর্তনের এক বিরাট চাপ তৈরি হয়, ফলে অতীতের দাতাদের থেকে আপাত সম্পর্ক ছিন্ন হয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নতুন ধারার সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে বহু বিষয়ে কঠিন স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রাষ্ট্রীয়করণের নতুন নীতিগুলো দেশি সমাজ ব্যবস্থা, শিল্প ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, শ্রমবাজার ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অপরীক্ষিত ছিল বলে তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না।

ফলে কিছু আইন বারবার পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হয়েছে। এতে একদিকে সময় নষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে শিল্প অধিগ্রহণের কারণে অর্থনীতিতে ব্যাপক আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বড় ও মাঝারি শিল্পের একমুখী রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, বেসরকারি খাতের বিকাশ বন্ধের জন্য বিনিয়োগে খুব নিম্ন সিলিং, লভ্যাংশের সীমা নির্ধারণ, বিদেশিদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার নিষিদ্ধকরণের ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্যসহ বহু কূটনৈতিক বিষয়ে বাংলাদেশ টানাপোড়েনে পড়ে।

পরে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত আগ্রাসন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আগ্রাসনের প্রস্তুতি নিলে বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিস্তৃত হয়। এই সবকিছু মিলিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নবযাত্রা সহজ বা সুখকর ছিল না।
প্রায় সর্বসম্মত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সংবিধানে গৃহীত হলেও এতে তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মেরুকরণের গুরুতর সমস্যা।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও খাদ্য সাহায্য মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ছিল (যেমন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ, পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি, কলেরা হাসপাতাল, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা ইত্যাদি)। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট দাতা সংস্থা যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ, এমনকি জাতিসংঘও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সাহায্যদানের আশ্বাসকে কার্যত কঠিন শর্তসাপেক্ষ করে দেয়।

সমাজতন্ত্র ও বেসরকারিকরণ (পুঁজিবাদ) প্রশ্নে বাংলাদেশের নতুন নির্মিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আইন পশ্চিমা দেশ ও বৈদেশিক সাহায্যদাতা সংস্থাগুলো মেনে নেয়নি। অভ্যন্তরীণ মজুতদারি, ত্রাণ লুটপাট ও কালোবাজারি থেকে উদ্ভূত খাদ্যসংকট ১৯৭৪ সাল দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। বিদেশি খাদ্যসাহায্য আসতে বেশ দেরি হলে দুর্ভিক্ষ গুরুতর আকার ধারণ করে।

এই কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো সমাজতান্ত্রিক দর্শন থেকে স্থায়ীভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দর্শন বাংলাদেশের প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে কখনোই সফল বাস্তবতা হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। মৌলিক নাগরিক সেবায় রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ জোরদার করার উদ্যোগ বেসরকারিকরণের পুঁজিবাদী কাঠামোর ভেতরে থেকেই দায়সারাভাবে চলতে থাকে। পর্যাপ্তসংখ্যক স্বাধীন ও সক্ষম প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি বলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা সেবাগুলো সাধারণ নাগরিকের প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ শীর্ষক গ্রন্থের রচয়িতা।
[email protected]

সহায়ক তথ্যসূত্র:
১। অর্থনীতিবিদ রজার মিডলটন এবং রবার্ট স্কিডেলস্কি।
২। ‘বিশ্বায়ন: বিতর্কিত এক ভুবন’, বদরুল আলম খান, ১৯ মে ২০১৮, প্রতিচিন্তা।
৩। জার্নাল ‘Is the ‘Beijing Consensus’ now dominant? জানুয়ারি ২০১২ John Williamson। <https://www.jstor.org/stable/24905162?seq=1 >]
৪। <https://www. oecd.org/inclusive-growth/>
৫। <https://www. un. org/sustainabledevelopment/sustainable-development-goals/>
৬। অমর্ত্য সেন (১৯৮২)। Poverty and famines: An essay and entitlement and deprivation [দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ: একটি প্রবন্ধ এবং অধিকার এবং বঞ্চনা]