বাংলাদেশের তিন নায়ককে অভিনন্দন

আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বছরের অর্ধেক সময় গ্রামে থাকেন। তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এলে আলাপ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, গ্রামের মানুষ কেমন আছেন? তিনি বললেন, যেসব পরিবারের কোনো সদস্য শহরে বা বিদেশে চাকরি করেন, তঁারা মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন। কৃষিশ্রমিকেরা দিনে ৫০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু বিপদে আছেন কৃষকেরা। তাঁরা উৎপাদিত ধান বিক্রি করে যে টাকা পান, তাতে খরচই ওঠে না।

তাহলে তাঁরা চলছেন কীভাবে?

বন্ধুর জবাব, নিরুপায় কৃষক এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করেন, এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিওর ঋণ শোধ করেন। গ্রামে ঋণদানকারী এনজিওগুলোর এখন রমরমা অবস্থা।

অথচ বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। কৃষিতে ৪১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান কত ভাগ, কেবল তা দিয়ে কৃষকের অবদান নিরূপণ করা যাবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, তাঁরা ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছেন। এর পেছনে নিশ্চয়ই সরকারের সহায়ক নীতির ভূমিকা আছে। তারপরও কৃষির উন্নয়নে মূল অবদান কৃষকেরই। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করে তাঁরা মাঠে ফসল ফলান। কিন্তু এত কষ্ট করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষক যে শস্য ঘরে তুলে আনেন, প্রায়ই তার ন্যায্য দাম পান না। অনেক সময় পোকার আক্রমণে ফসল নষ্ট হয়, বন্যা খেতের শস্য ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপরও তাঁরা হতোদ্যম হন না। ধারকর্জ করে হলেও আবার মাঠে ফসল বোনেন।

বাংলাদেশে কৃষক সম্ভবত সবচেয়ে সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল মানুষ। ভারতের কৃষকেরা নতুন কৃষি আইন বাতিল ও শস্যের ন্যায্য দামের দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করেছেন। একপর্যায়ে তাঁরা দিল্লি অচল করে দিয়েছেন। ভরতের কৃষকদের এ আন্দোলনের পেছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আছে। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষকদের পক্ষে কথা বলার কোনো দল নেই। তাই কৃষক যত বিপদে থাকুন না কেন, আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন না। নিজেদের ন্যায্য দাবি নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে রাস্তা বন্ধ করে দিতে পারেন না।

দেশের উন্নয়নে পূর্বাপর সরকারের নীতিনির্ধারক, প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা কৃতিত্ব দাবি করেন। তাঁদের দাবি অমূলক নয়। তাঁদের পুরস্কার-পদক প্রদান অনুষ্ঠানের ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়, টেলিভিশনে দেখানো হয়। তাঁরা ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষ। কিন্তু এ সাফল্যের প্রকৃত যে হকদার, সেই প্রান্তজন কৃষকের ছবি প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ছাড়া ছাপা হয় না। অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটলেই তাঁরা খবর হন।

বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রায়ই একটা কথা বলেন, পাকিস্তান আমলে ছিল ‘এক দেশ, দুই অর্থনীতি’। বাংলাদেশ আমলে হয়েছে ‘এক দেশ, দুই সমাজ’। একটি ধনী সমাজ, আরেকটি গরিব সমাজ। অন্য ভাষায় বলা যায়, একটি ভদ্রলোক সমাজ, অপরটি প্রান্তজন সমাজ। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাবর ভদ্রলোক সমাজ অগ্রাধিকার পায়। প্রান্তজনেরা প্রান্তেই থেকে যান।

আমাদের সংবিধানে কৃষিবিপ্লবের বিকাশের কথা আছে। নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য কমানোর কথা আছে। নারী-পুরুষের সমতা বিধানের কথা আছে। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা আছে। গত ৫০ বছরে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি করেছি, মাথাপিছু আয় ও আয়ু বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে। নতুন নতুন রাস্তাঘাট হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কমেনি। গরিব আরও গরিব হয়েছেন। করোনার আগে ২০ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, করোনাকালে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে।

সংবিধানে বর্ণিত কৃষিবিপ্লব অনেকটা সফল হলেও কৃষকদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। এ এক অদ্ভুত ধাঁধা।

আমরা যদি কৃষককে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রথম নায়ক হিসেবে অভিহিত করি, দ্বিতীয় নায়ক ৪০ লাখ তৈরি পোশাকশ্রমিক, যাঁদের ৮০ ভাগ নারী। তাঁরা কম মজুরি পান, অনেক কারখানায় নিয়মিত মজুরিও দেওয়া হয় না। তারপরও তাঁরা এ কাজকে গৃহকর্মীর কাজ কিংবা ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার চেয়ে উত্তম মনে করেন। কেবল শ্রমিক নন, মানুষ হিসেবে নিজের একটি পরিচয় খুঁজে পান। এ খাতের শ্রমিকেরা আমাদের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য যে কত অপরিহার্য, করোনাকালে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যখন সারা দেশে লকডাউন চলছিল, তখন তাঁরা দূরদূরান্ত থেকে কারখানায় এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা কাজ করেছেন বলেই বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয় পেয়েছে ২ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার।

আমাদের অর্থনীতির তৃতীয় নায়ক হলেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। তাঁদের অনেকেই দেশে-বিদেশে প্রতারিত হন। নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে, যার বড় অংশ এসেছে তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয় থেকে। বর্তমানে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে কাজ করছেন। তাঁদের আয়ের ওপর কয়েক কোটি মানুষের খাওয়া–পরা নির্ভর করছে। এই প্রবাসী শ্রমিকেরা যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে কেবল একটি লাল-সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে যাচ্ছেন না, তাঁরা নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ভাষা, সংস্কৃতিও। প্রবাসীরা মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় গড়ে তুলেছেন টুকরা টুকরা বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিট্যান্স ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রবাসী আয় হয়েছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। আমাদের কৃষকেরা শস্যের ন্যায্য দাম পেলে সময়মতো সার, বীজ ও সেচ সুবিধা পেলে তাঁরা আরও বেশি উৎপাদন করতে পারবেন।

তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে এবং কর্মস্থলের পরিবেশ উন্নত হলে তাঁরা আরও বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে পারেন। প্রবাসী শ্রমিকদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে পারলে এবং প্রতারণা বন্ধ হলে তাঁদের আয় আরও বাড়বে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির এই তিন নায়ককে অভিনন্দন।


সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]