বাংলাদেশের ৫০ বছর: অর্জনের পাশে বঞ্চনার কাঁটা বিঁধছে চট্টগ্রামবাসীকে

চট্টগ্রাম শহরের গোড়াপত্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চেরাগীর পাহাড়
ছবি: সৌরভ দাশ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে চট্টগ্রামের অর্জনের কথা ভাবলে চট্টগ্রামবাসীর চেহারা কিছুটা বিবর্ণ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানান ক্ষেত্রে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো প্রভূত উন্নয়ন আমাদের হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর পাওনার হিস্যায় কিছুটা বৈষম্য আছে। চট্টগ্রাম নগরে দৃশ্যমান অগ্রগতি বা উন্নয়ন অনেক। বড় বড় সড়কগুলোয় এখন ছায়া দিচ্ছে উড়ালসড়ক। নদীর গভীরের টানেল যোগাযোগব্যবস্থাকে নতুন শতাব্দীর জন্য যোগ্যতর করে তুলছে। সাগর আর নদীর তীর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সুদীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ। চট্টগ্রামের বটতলী রেলওয়ে স্টেশন থেকে দোহাজারী ছাড়িয়ে রেল চলে যাবে দরিয়া নগর কক্সবাজারে। ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারের স্বতন্ত্র টেলিভিশন কেন্দ্র। এই সব চোখধাঁধানো অর্জনের পাশাপাশি কিছু বঞ্চনার বিষয় আজ উচ্চারণের সময় এসেছে। কারণ, এসব মৌলিক বিষয় যদি অপূর্ণ থাকে, তাহলে অন্য সব প্রাপ্তিকে মলিন করে তুলবে।

বাড়েনি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

প্রথমেই তুলে ধরতে চাই শিক্ষা ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব–নিকাশ। গত ৫০ বছরে চট্টগ্রাম একটি শিক্ষা বোর্ড পেয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম। কিন্তু ৫০ বছরে চট্টগ্রাম শহরে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন করে কোনো সরকারি স্কুল বা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৪ সালে এবং ২০১৭ সালে দুটো বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলকে সরকারীকরণ করা হয়েছিল। এর বাইরে আর কোনো নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে ৩৫টিতেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এই দেশে শুধু চট্টগ্রাম শহরেই ৭০ লাখের মতো মানুষ। জনসংখ্যা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই পরিসংখ্যানে অনুপাতের হিসাবটা সত্যিই ভারসাম্যহীন। বছর শেষে আসন্ন নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যাপারে অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন।

জলাবদ্ধতার দুঃখ
নিয়তির মতোই চট্টগ্রামের কপালে জলাবদ্ধতার দুঃখ লেগে আছে বছরের পর বছর। জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৫ হাজার ৬ শত ১৬ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটির কাজ এখনো চলছে। এই প্রকল্পের ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এই কাজের কোনো সুফল চট্টগ্রামবাসী দেখতে পাচ্ছে না। বাকি ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার প্রতীক্ষায়। এর মধ্যে নালা–নর্দমায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। জলাবদ্ধতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। চট্টগ্রাম শহরে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি বলেই বর্জ্যে নালা, নর্দমা, খাল ভরাট হয়ে গেছে। আর জলাবদ্ধতার জন্য বেশির ভাগ দায়ী এই বর্জ্য। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তাদের ডোর টু ডোর কার্যক্রমে শতভাগ সফল বলে দাবি করে মূলত মিছেমিছি আত্মতৃপ্তিতেই ভুগছে সংস্থাটি।

নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

চট্টগ্রামের বিভিন্ন আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকার মোড়ে মোড়ে বর্জ্য পড়ে থাকে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট নালা ও খাল ভরে থাকে বর্জ্যে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর মেডিকেল বর্জ্যের কোনো সুব্যবস্থাপনা নেই। একসময়ের ছিমছাম পরিচ্ছন্ন নগর চট্টগ্রাম এখন অপরিচ্ছন্ন, আবর্জনার গন্ধে ভরা, ধুলায় ধূসর নগরে পরিণত হয়েছে। সিটি করপোরেশন বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য নানান উদ্যোগ নিয়েছে। বর্জ্য থেকে সার উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছে। এই প্রকল্প আরও বড় করতে হবে। যাতে নগরের অধিকাংশ বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের আওতায় চলে আসে। সিটি করপোরেশন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা সফল হয়নি। বর্জ্য ব্যবস্থার উন্নতি না হলে শহরের মান ও সৌন্দর্য দুটোই নষ্ট হবে। বিপন্ন হবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য।

গত ৫০ বছরে চট্টগ্রাম যা পেয়েছে, তার সৌন্দর্য আর গৌরব ম্লান না করার জন্য অপ্রাপ্তির তালিকাটা ছোট করতে হবে আগামী কয়েক বছরে। একটি জনবান্ধব সরকারের পক্ষে সেটি সম্ভব বলে চট্টগ্রামবাসী মনে করে। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিক উদ্যোগ। তাতে শুধু চট্টগ্রামের লাভ হবে না, পুরো দেশের লাভ। কারণ, চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে তো দেশেরই উন্নয়ন।

নকশাবিহীন ভবন নির্মাণ
চট্টগ্রাম শহরকে অপরিকল্পিত ও ঘিঞ্জি গলির শহরে পরিণত করার পেছনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) সবচেয়ে বেশি দায়ী। এই প্রতিষ্ঠান কানে তালা, চোখে কাপড় বেঁধে রেখেছে। আর নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় অগুনতি ভবন গড়ে উঠছে, যার বেশির ভাগেই ইমারত বিধিমালা মানা হচ্ছে না। চউক’র নজরদারি এ ব্যাপারে শতভাগ উদাসীন। তারা একধরনের নকশা পাস করে, আর ভবন নির্মাতারা ভবন বানান অন্য নকশায়। এতে এই প্রতিষ্ঠানের কিছুই আসে যায় না। একটি নগরকে মানুষের ভোগান্তির নগরে পরিণত করতে এ রকম উদাসীন দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিষ্ঠান একটিই যথেষ্ট।

রাস্তা খুঁড়াই ওয়াসার কাজ
চট্টগ্রাম নগরের মানুষদের ভোগান্তির আরেকটি কারণ সুপেয় পানি। আর এই পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াসার কাজ শুধু বছরজুড়ে রাস্তা কাটা। ওরা রাস্তা খুঁড়বে, গর্ত করবে সারা বছর। আর মানুষ পানির কষ্টে ভুগবে দিনের পর দিন। ওয়াসা তবু তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। তাদের বক্তব্য, চাহিদার তুলনায় তাদের উৎপাদন বেশি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নগরের সব জায়গা ওয়াসার আওতায় আসেনি। অনেক জায়গায় এখনো পাইপলাইন যায়নি। যেখানে যেখানে লাইন আছে, সেখানে নিয়মিত পানি পাওয়া যায় না। অথচ মাটির গভীর ওয়াসার বড় বড় টানেলের মতো পাইপলাইন গেছে। মানুষ তবু পানি পায় না।

হয়নি পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা
পানি সরবরাহ ছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসার আরেকটি কাজ আছে—পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা। কিন্তু ৫৮ বছর বয়সী এই প্রতিষ্ঠান সেই কাজে হাত দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম শহরে কোনো পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নেই। ফলে নগরের সব পয়োবর্জ্য নালা–খালের মাধ্যমে হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। আর ওয়াসা এই দুটি নদী থেকেই নগরে পানি সরবরাহ করছে। এতে সুপেয় পানি নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে।

কবে হবে কালুরঘাট সেতু
চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থায় অনেক উন্নতি হয়েছে, উন্নয়ন চলছে, কিন্তু এই সব উন্নয়নকে যেন ঢেকে দিয়েছে কালুরঘাট সেতুর দুঃখ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, জীর্ণ এই সেতু চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থাকে অন্তত ৫০ বছর পিছিয়ে রেখেছে। একটা জনপদে তৈরি হয়েছে অচলায়তন। এই অচলায়তন ভাঙার দাবি বহুদিনের। কত নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, কিন্তু কালুরঘাট অন্ধকারে থাকে। এর রহস্য মানুষ বোঝে না। এই রহস্য উন্মোচিত হোক।

অপরিকল্পিত নগরায়ন
আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতি হিসেবে আমাদের বহু অর্জন। কিন্তু একটি মোটামুটি উন্নত শহরে যেসব উন্নয়ন না হলেই নয়, সেই হিসেবে আরও কিছু অপ্রাপ্তির কথা উল্লেখ করা জরুরি। লোকসংখ্যার ঘনত্ব অনুযায়ী এই শহরে খোলা জায়গা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে মাঠ-ময়দানের সংখ্যা। যে কয়টি হাতে গোনা মাঠ আছে, সেগুলো প্রায়ই নানান মেলা ও অনুষ্ঠানের জন্য দখলে থাকে। চট্টগ্রাম শহরে এই অর্ধশত বছরে একটি মাঠও নতুন করে তৈরি হয়নি। নতুন কোনো পার্কও তৈরি হয়নি। মুছে গেছে বহু জলাশয়। কাটা হয়ে গেছে অধিকাংশ পাহাড়। প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে আমরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। নদী ও খাল হয়েছে দূষণকবলিত। অথচ বেড়েই চলেছে পরিকল্পনা ও নকশাবিহীন উঁচু উঁচু দালান। বহুতল ভবনের জন্য চারপাশে যে খোলা জায়গা রাখার বিধান আছে, তা মানা হচ্ছে বেশির ভাগ ভবনে। চউক তাতে নির্বিকার।

এই সব দুঃখগাথার পাশাপাশি বাণিজ্যিক রাজধানী বলে খ্যাত চট্টগ্রাম বাণিজ্যিকভাবেও গুরুত্ব হারাচ্ছে দিন দিন। বিগত দিনগুলোয় বহু করপোরেট কোম্পানি তাদের সদর দপ্তর গুটিয়ে নিয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। গুরুত্ব হারিয়েছে একসময়ের সারা দেশের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী যাঁরা আমদানি–রপ্তানির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অনেক কাজে ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হয়। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি কাজে সীমাবদ্ধতা, আন্তর্জাতিক বিমান সেবার অপ্রতুলতা, টার্মিনাল না থাকার কথা, আর্থিক প্রতারণার কথা, সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাট এলাকায় গাড়ির ওজন পরিমাপক যন্ত্রের কথা বারবার বললেও এগুলোর কোনো সুষ্ঠু সমাধান হচ্ছে না।

গত ৫০ বছরে চট্টগ্রাম যা পেয়েছে, তার সৌন্দর্য আর গৌরব ম্লান না করার জন্য অপ্রাপ্তির তালিকাটা ছোট করতে হবে আগামী কয়েক বছরে। একটি জনবান্ধব সরকারের পক্ষে সেটি সম্ভব বলে চট্টগ্রামবাসী মনে করে। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিক উদ্যোগ। তাতে শুধু চট্টগ্রামের লাভ হবে না, পুরো দেশের লাভ। কারণ, চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে তো দেশেরই উন্নয়ন।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক