বাইডেন কেন সৌদি যুবরাজকে শাস্তি দিলেন না

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

আমেরিকাপ্রবাসী সৌদি সাংবাদিক  জামাল খাসোগিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট অফিসের ভেতরে কারা কীভাবে হত্যা করেছিল, মার্কিন গোয়েন্দারা তার আদ্যোপান্ত জেনে নিয়েছিলেন। গোয়েন্দাদের গোপন নথি প্রকাশ করার দাবিতে আমেরিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যত দিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তত দিন সেই গোয়েন্দা নথি প্রকাশ করতে দেননি। নাছোড়বান্দা সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় জেরবার ট্রাম্প অবিরাম ‘গাঁইগুঁই’ করে গেছেন; কখনোই স্পষ্ট করে বলেননি তাঁর গোয়েন্দারা খাসোগির হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁকে কী জানিয়েছেন।

জো বাইডেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরেই তাঁর প্রশাসন খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করল। ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘অফিস অব দ্য ডিরেক্টরেট অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স’ তিন পৃষ্ঠার এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, সেই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ নতুন বাইডেন প্রশাসনের সময়েই।

এর মানে কি এই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে মার্কিন গোয়েন্দারা জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন তৈরি করেননি?

আমাদের তা মনে হয় না। বরং আমাদের বিশ্বাস, প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকালের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘ডিক্লাসিফাই’ (প্রকাশ) করেছেন, সেটা এটা নতুন প্রতিবেদন। এটা তাঁদের তৈরি করার প্রয়োজন হয়েছে সৌদি আরবের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। সম্ভবত ট্রাম্পের আমলে তৈরি গোয়েন্দা প্রতিবেদন বা নথিপত্র বাইডেন প্রশাসনের সেই কৌশলের পক্ষে জুতসই নয়।

বাইডেন প্রশাসনের উন্মোচিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন, যার শিরোনাম ‘অ্যাসেসিং দ্য সৌদি গভর্নমেন্টস রোল ইন দ্য কিলিং অব জামাল খাসোগি’ (জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকারের ভূমিকার মূল্যায়ন), এমন সংক্ষিপ্ত যে আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে কেউ কেউ এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যেসব বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে সেসবের উল্লেখমাত্র নেই। শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনের একদম শেষে বলা হয়েছে, ‘খাসোগির বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানটিতে তাঁর মৃত্যু ঘটবে—এটা এই ব্যক্তিরা আগে থেকে জানতেন কি না তা আমাদের জানা নেই।’

মার্কিন গোয়েন্দাদের এ মন্তব্য থেকে মনে হয়, খাসোগিকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে—এটা তাঁরা বলতে চান না। এটা নিঃসন্দেহে দায়সারা অবস্থান; এভাবে ওই নৃশংস অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অপরাধকে লঘু দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ সৃষ্টি হয়।

তবে এসব সত্ত্বেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে যেটুকুই বলা হয়েছে, সৌদি যুবরাজকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করার জন্য সেটাই যথেষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
‘আমাদের মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে আটক বা হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি অভিযান অনুমোদন করেছিলেন। আমাদের এ মূল্যায়নের ভিত্তি হলো, ২০১৭ সাল থেকে সৌদি রাজতন্ত্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুবরাজ সালমানের নিয়ন্ত্রণ, ইস্তাম্বুলের অভিযানে তাঁর একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ও তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা এবং খাসোগিসহ বিদেশে সৌদি ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে সহিংস পন্থার প্রতি যুবরাজের সমর্থন।
‘২০১৭ সাল থেকে যুবরাজ সালমান সৌদি রাজতন্ত্রের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ভোগ করে আসছেন, সুতরাং তাঁর অনুমোদন ছাড়া সৌদি কর্মকর্তারা এই মাত্রার কোনো অভিযান পরিচালনা করেছেন—এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

হত্যাকাণ্ডের শিকার সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগি

‘খাসোগি হত্যাকাণ্ডের সময় যুবরাজ সম্ভবত এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে তাঁর সহযোগী লোকজনের মনে এমন ভীতির জন্ম হয়েছিল যে তিনি তাঁদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালনে ব্যর্থতার পরিণাম হবে চাকরিচ্যুতি কিংবা গ্রেপ্তার। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, যুবরাজের সহযোগীরা তাঁর আদেশের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি বা তাঁর সম্মতি ছাড়া কোনো স্পর্শকাতর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম ছিলেন না।

‘২০১৮ সালের ২ অক্টোবর ১৫ সদস্যের যে সৌদি দলটি ইস্তাম্বুল পৌঁছায়, তারা হয় সৌদি রাজদরবারের সেন্টার ফর স্টাডিজ অ্যান্ড মিডিয়া অ্যাফেয়ার্সের (সিএসএমআরসি) কর্মী ছিলেন অথবা সেটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। খাসোগি হত্যা অভিযানের সময় সিএসএমআরসির প্রধান ছিলেন যুবরাজ সালমানের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানি, যিনি ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে যুবরাজের অনুমোদন ছাড়া তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন না।

‘ইস্তাম্বুলগামী সৌদি দলটিতে আরও ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত এলিট বাহিনী র‌্যাপিড ইন্টারভেনশন ফোর্সের (আরআইএফ) সাতজন সদস্য। সৌদি রয়্যাল গার্ডের অংশ আরআইএফের দায়িত্ব যুবরাজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এই বাহিনী জবাবদিহি করে শুধু যুবরাজের কাছেই এবং তারা ইস্তাম্বুলের ওই অভিযানের আগে বিভিন্ন সময়ে যুবরাজের নির্দেশেই সৌদি আরবের ভেতরে এবং বাইরের বিভিন্ন দেশে সৌদি ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের অভিযানে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। আমাদের বিচারবুদ্ধি বলে, আরআইএফের সদস্যরা মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুমোদন না পেলে খাসোগির বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিতেন না।

‘জামাল খাসোগিকে যুবরাজ সালমান সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে মনে করতেন এবং তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ করতে প্রয়োজন হলে সহিংস পন্থা অবলম্বনের প্রতি তাঁর সায় ছিল।...আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নিচে উল্লেখিত ব্যক্তিরা জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডে মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছিলেন, আদেশ দিয়েছিলেন, অথবা কোনোভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, অথবা কোনো না কোনোভাবে দায়ী।’

মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে নিবিড় সহযোগিতার সম্পর্ক আছে, বিশেষত তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ইরানকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সৌদি আরব যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন তা কোনোভাবেই হারাতে চায় না।

বাইডেন প্রশাসনের সুবিধার্থে যুবরাজ সালমানকে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা না বলে ‘অনুমোদনকারী’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। কিন্তু এই অনুমোদনের প্রকৃত অর্থ কী, তা বুঝতে কারও বাকি নেই: সৌদি যুবরাজের হাত সৌদি সাংবাদিক খাসোগির রক্তে রঞ্জিত। কিন্তু সে জন্য বাইডেন প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। বরং জানা গেল, গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার ঠিক আগের দিনই প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি বাদশাহ সালমানকে ফোন করেছিলেন। তাঁদের কথোপকথনে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ ছিল না, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি বাদশাহকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যতটা সম্ভব শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করার জন্য তিনি কাজ করে যাবেন।

এর ঠিক এক সপ্তাহ আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ফোন করেছিলেন সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে। তাঁদের আলাপেও খাসোগি হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। অস্টিন যুবরাজকে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তাকাঠামোর একটা স্তম্ভ হিসেবে সৌদি আরবের ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

এ পরিস্থিতিতে বাইডেন প্রশাসন কী ফায়দার আশায় জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজের ‘অনুমোদন’ ছিল বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করল? এবং সৌদি যুবরাজের হাত তাঁরই দেশের একজন সাংবাদিকের রক্তে রঞ্জিত—এটা বলার পরও হোয়াইট হাউস কেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিল না? বরং উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো সৌদি সরকারের ৭৬ জন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেবে না বলে ঘোষণা দিয়ে দায় সারতে চাইল?

আমরা বরাবর দেখে এসেছি, যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তন হলেই তার পররাষ্ট্রনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসে না। যে ট্রাম্প ‘আমেরিকাই প্রথম’ স্লোগান দিয়ে বহির্বিশ্ব থকে দৃষ্টি অনেকাংশে সরিয়ে ঘরের দিকে নিবদ্ধ করেছিলেন, তাঁর প্রশাসনও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর আগের ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি থেকে খুব বেশি দূরে সরে যায়নি। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-সৌদি আরবের স্বার্থকেন্দ্রিক মার্কিন নীতি একই ধারাবাহিকতায় পরিচালিত হয়েছে। খামখেয়ালি ট্রাম্প শুধু ইরানের সঙ্গে বহুপক্ষীয় চুক্তি থেকে সরে যাওয়া ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির বড় কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি।

ট্রাম্পের আমলে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেভাবে বিকশিত হয়েছে, বাইডেন প্রশাসন তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাবে। খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা একটা মানবাধিকার ইস্যু, যা মার্কিন প্রশাসন বরাবরই বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। কিন্তু তাদের এ গুরুত্ব নির্ভর করে তাদের রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের ওপর। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে নিবিড় সহযোগিতার সম্পর্ক আছে, বিশেষত তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ইরানকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সৌদি আরব যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন তা কোনোভাবেই হারাতে চায় না। সৌদি আরবের সঙ্গে বিদ্যমান সুসম্পর্কের ক্ষতি হয়, এমন কোনো পদক্ষেপই বাইডেন নেবেন না।

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, হোয়াইট হাউসের অন্দরমহলে সবাই এমন ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে খাসোগি হত্যায় ভূমিকার জন্য সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে মার্কিন-সৌদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে মাশুল গুনতে হতে পারে, তা খুবই বেশি হয়ে যাবে।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক।
[email protected]