বাইডেন-পুতিন বৈঠকেও সম্পর্কের বরফ গলছে না

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

জেনেভায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ১৬ জুন বৈঠক করার পর সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমাদের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে।’ বৈঠক নিয়ে বলা যায় এটিই ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের সারকথা।

জেনেভায় অনুষ্ঠিত ও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্কোন্নয়নে বড় ধরনের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মেলেনি। গত এক দশকে দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় এসেছে। সে সম্পর্ক এ বৈঠক থেকে মেরামত করা গেছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।

মস্কো ও ওয়াশিংটন পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও সেই ধারা বজায় থাকবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কৌশলগত ও আদর্শিক কারণে সে অবস্থান থেকে তারা সরে আসবে, এমন কোনো আলামতও দেখা যাচ্ছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে ‘রিসেট’ করতে চেয়েছিলেন বলে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে পুতিনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের পর যে কথা বলা হচ্ছিল, আদতে তার কিছুই হয়নি বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

জেনেভা সম্মেলনে পুতিন ও বাইডেনের তিন ঘণ্টার যে বৈঠক হয়েছে, তাতে ভদ্রোচিত আলাপ হলেও ওয়াশিংটন ও মস্কো এতে আরও শীতল অবস্থানে এসেছে। যৌথ বিবৃতিতে চলতি বছরের শুরু থেকে রাশিয়া ও আমেরিকা কৌশলগত সামরিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যেসব অর্জন করেছে, যৌথ বিবৃতিতে সেটিই ফলাও করা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ‘নিউ স্টার্ট ট্রিটি’ নামের একটি চুক্তি আছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সেটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে গত ২৬ জানুয়ারি পুতিন ও বাইডেন টেলিফোনে সেই চুক্তিকে আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করতে রাজি হন। নবায়িত চুক্তির সম্ভাব্য বিভিন্ন দিক নিয়ে এখন উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখছেন।

দুই দেশ পরস্পরের রাজধানী থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বাইডেন ও পুতিন আবার পরস্পরের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করতে সম্মত হয়েছেন।

দুই দেশের কূটনৈতিক দূরত্ব কমানোর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু দিয়ে শুরু হতে পারে। বাইডেন-পুতিন বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় সিরিয়ায় একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালানো হোক, বিশেষ করে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত দিয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা দুর্গতদের মধ্যে পাঠানো হোক। তাতে রাশিয়ার দ্বিমত আছে।

ইরানের পরমাণু কার্যক্রম ইস্যুও বাইডেন-পুতিন বৈঠকে উত্থাপিত হয়েছে। এ ইস্যুতে মস্কো ও ওয়াশিংটন সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। বাইডেন প্রশাসন যেহেতু বিগত ট্রাম্প প্রশাসনের ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে ভালোভাবে নেয়নি এবং আবার এ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, সেই দিক বিবেচনায় রেখে বাইডেন ওই চুক্তির অন্যতম অংশীদার রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে আলাপে আগ্রহী আছে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর কী সংকট দেখা দিতে পারে, তা নিয়ে এ দুই নেতার আলোচনা হতে পারত। না যুক্তরাষ্ট্র, না রাশিয়া—কেউ চায় না আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসুক। আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার পরপরই কাবুলে তালেবানের উত্থান হবে—এ বিষয়টি মস্কোর জন্যও উদ্বেগের। এটি নিয়েও দুই নেতার আলোচনা হতে পারত। এতে ওয়াশিংটন ও মস্কোর ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হতো।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক জিইয়ে রাখবে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে যেমন কর্তৃত্ববাদী শাসনের ঝান্ডাধারী হিসেবে বিবেচনা করে, একইভাবে রাশিয়াকেও তারা একইভাবে স্বৈরশাসক হিসেবে মনে করে। অন্যদিকে মস্কো আমেরিকাকে আগের মতোই সন্দেহের চোখে দেখছে।

জেনেভা বৈঠকে বাইডেনের মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে এ বার্তা দেওয়া যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত আসে এমন কোথাও কোনো রুশ তৎপরতা থাকলে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আঘাত হানবে। এমনকি ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া যেভাবে সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেছিল, সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি যদি রাশিয়া আবার সৃষ্টি করে, তাহলে তার মোক্ষম জবাব দেওয়া হবে।

এ শীতল সম্পর্ককে উষ্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়ার উপায় উভয় পক্ষকে খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় অগ্রসর হতে হবে। তবে খারাপ করা খবর হলো, আপাতত সে ধরনের কোনো লক্ষণ আমাদের সামনে নেই।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

দিমিতার বেচেভ ভিয়েনার ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান সায়েন্সের ফেলো