বাইডেনকে মোহাম্মদ বিন সালমানের দ্বারস্থ হতেই হচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

রাজনৈতিক আলাপচারিতায় ‘রিয়ালপলিটিক’ (Realpolitik) শব্দটি এখন বেশুমার ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিধান ‘রিয়ালপলিটিক’কে ‘নীতি-আদর্শের বদলে ক্ষমতার ভিত্তিতে অনুসৃত নীতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে থাকে। সৌদি আরবে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আসন্ন সাক্ষাৎপর্বে আমরা ‘রিয়ালপলিটিক’-এর একটি বাস্তব সংস্করণ দেখতে যাচ্ছি।

এ মাসের শেষে ইসরায়েলে যাত্রাবিরতি করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর বাইডেন রিয়াদে যাবেন। সৌদি আরবে অবস্থান করার সময় গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের এ বছরের আয়োজক দেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও কাতারের মতো বন্ধুপ্রতিম আরব দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। তবে এ সবকিছুকে ছাপিয়ে মোহাম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে জো বাইডেনের করমর্দনের দৃশ্য সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচকদের কাছে সেটি একটি ভীতিজাগানিয়া মুহূর্ত হিসেবে ধরা দেবে। তাঁরা বিশ্বাস করেন এবং খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে, আমি নিজেও বিশ্বাস করি, মোহাম্মদ বিন সালমানের হাতে রক্ত লেগে আছে। কারণ, সিআইএ নিশ্চিত করে বলেছে, তাঁর নির্দেশেই ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বহু মাস ধরে মার্কিন নেতাদের মোহাম্মদ বিন সালমানের বিষয়ে নরম সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। এটি আমাদের জন্য অস্বস্তির বিষয় হলেও অনেকেই বুঝতে পারছেন, এর পেছনে বাস্তবভিত্তিক কারণ আছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সবাই বুঝতে পারছেন, সম্ভবত আগামী কয়েক দশক মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরব শাসন করবেন; সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ অংশীদারি বজায় রাখার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং আর্থিক স্বার্থ রয়েছে এবং সৌদি আরব এ অঞ্চলে ইরানের অস্থিতিশীল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন প্রচেষ্টার মিত্র হিসেবে কাজ করছে।

বাইডেনের সৌদি সফরের পেছনে দুটি নতুন কারণ রয়েছে। প্রথমটি হলো, ইউক্রেনে যুদ্ধ ও এর কারণে তেলের বাজারে সৃষ্ট অস্থিরতা এড়াতে বাইডেনের সৌদি সাহায্যের প্রয়োজন। দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাইডেনের প্রতি ইসরায়েলের চাওয়া, তিনি যেন আব্রাহাম অ্যাকর্ডের (যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সহযোগিতা চুক্তি) স্বার্থে মোহাম্মদ বিন সালমান এবং সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেন।

ওয়াশিংটন মনে করছে, বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা সফল হলে সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে; তারা বেশি করে তেল উৎপাদন করতে সম্মত হবে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনুরূপ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সমর্থন করবে। এটি তেলের দাম কমিয়ে দেবে। বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙা করবে এবং রাশিয়াকে দুর্বল করে দেবে। এ বিবেচনাই বাইডেনকে মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছে টেনে আনছে।

একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা আমাকে কয়েক দিন আগে বলছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এই অঞ্চল এবং এর বাইরেও সৌদি আরব একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করে। জ্বালানি বাজারকে স্থিতিশীল রাখা, ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার স্বার্থে আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সমর্থন করি।’

সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তা যোগাযোগ ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। অবশ্য সেগুলোর বেশির ভাগই অদৃশ্যমান এবং এখান থেকে তাদের শিগগিরই সরে আসার সম্ভাবনা নেই।

মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেনের সফর অনেকের মনে একই ফ্রেমে বাইডেন-বেনেট-এমবিএস (মোহাম্মদ বিন সালমান)—এই তিনজনের ছবি দেখার আশা জাগিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সে সময় এখনো আসেনি। সম্ভবত আপাতত তাঁরা ইসরায়েলি বিমানকে সৌদির আকাশ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরের দৃশ্য দেখতে পাবেন।

মার্কিন-সৌদি সম্প্রীতির বিষয়ে ইসরায়েলের জোরালো চাপ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওয়াশিংটনে সৌদির পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার মতো লোকের সংখ্যা এখন খুবই কম। কয়েক দশক ধরে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট নেতাদের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের যে জোরালো সম্পর্কের সেতু গড়ে উঠেছিল, সেই সেতুকে রাজপরিবারই পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই দেশের বন্ধুত্বকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন বলে মনে হয়েছিল। তবে এর ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্ররাও রিয়াদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক পুনরায় মজবুত করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ উভয়েই সৌদি আরবে এসে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁরাও বাইডেনকে সৌদির সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করছেন।

বিন সালমানকে বাইডেন অনেক মাস ধরে এড়িয়ে যাচ্ছেন। গত বছর ক্রাউন প্রিন্স বাইডেনকে বন্ধুত্বপূর্ণ ফোন কল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাইডেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। আমার ধারণা, বাইডেনের এ অবজ্ঞা ও উপেক্ষার কারণটি ব্যক্তিগত। গত অক্টোবরে রোমে জি-২০ সম্মেলনে বাইডেন মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই বিন সালমান সেখান থেকে সরে গিয়েছিলেন। সেটি বাইডেনের জন্য খুবই বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

বাইডেন-বিন সালমান বৈঠকটি একটি বিশদ কার্যক্রমের অংশ হবে—এমনটি মনে করেন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা টম ডনিলন এবং হোয়াইট হাউসের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র। তাঁরা বলছেন, বিশদ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বাইডেন গত মাসে এশিয়ায় সফর করেছেন। এর পরের সপ্তাহে লস অ্যাঞ্জেলেসে ‘সামিট অব দ্য আমেরিকাস’ এর আয়োজন করা হয়েছিল। এই একই কারণে বাইডেনের এই মাসে ইসরায়েল ও সৌদি আরবে সফর রয়েছে। একই কারণে ২৯ ও ৩০ জুন ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন। এসব সফরের লক্ষ্য হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিকে শক্তিশালী করা।

এখন প্রশ্ন হলো বাইডেন প্রশাসন মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বসার বিনিময়ে কী পাবে। ওয়াশিংটন মনে করছে, বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা সফল হলে সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে; তারা বেশি করে তেল উৎপাদন করতে সম্মত হবে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনুরূপ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সমর্থন করবে। এটি তেলের দাম কমিয়ে দেবে। বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙা করবে এবং রাশিয়াকে দুর্বল করে দেবে। এ বিবেচনাই বাইডেনকে মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছে টেনে আনছে।

পররাষ্ট্রনীতিতে ‘রিয়েলপলিটিক’ এর স্থান আছে। আর তা আছে বলেই একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বাইডেনকে হাত মেলাতে হবে।

ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

ডেভিড ইগনাশিয়াস ওয়াশিংটন পোস্ট–এর পররাষ্ট্র বিষয়াদিসংক্রান্ত নিয়মিত কলাম লেখক