বাইডেনের ওস্তাদি চাল

জো বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন প্রথমবারের মতো ইউরোপে চললেন। ইংল্যান্ডে জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর তিনি যাবেন বেলজিয়ামের ন্যাটো সম্মেলনে। সেখান থেকে জেনেভায় বসবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে। কিন্তু এসব কার্যক্রমের স্থান ইউরোপ হলেও আসল মনোযোগে থাকবে চীন। কারণ, বাইডেনের কৌশলগত অগ্রাধিকারের লক্ষ্য হলো চীনের আচরণের বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করা।

চীনের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা ও ইউরোপের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব দেখে অনেক ইউরোপীয় নেতাই চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আমলকে তিতিবিরক্তির চোখে দেখছেন। এটাই বাইডেনের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে, যে সুযোগ তিনি কোনোমতেই হারাতে চান না। অদ্ভুত শোনালেও যে নর্ড স্ট্রিম ২–এর মাধ্যমে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে গ্যাস পাইপলাইনের সংযোগ হতে যাচ্ছে, তিনি তা থেকে বিশেষ করে জার্মানিকে বিরত রাখতে চান।

কিছু বছর যাবৎ বাইডেন বলে আসছেন যে নর্ড স্ট্রিম ২ ‘ইউরোপের জন্য এক মন্দ কারবার’। এটা মহাদেশের, বিশেষ করে পোল্যান্ড, ইউক্রেন এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা বিপর্যস্ত করে দেবে—এই হলো তাঁর যুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত জানুয়ারিতেই নিশ্চিত করে বলেছিলেন, নতুন প্রশাসন ওই পাইপলাইনের কাজ সম্পন্ন করা ‘যতভাবে পারে ঠেকিয়ে দেবে’।

কিন্তু নর্ড স্ট্রিম ২–কে নস্যাৎ করায় যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টা ট্রান্স–আটলান্টিক জোটের জন্য এক মারাত্মক আঘাত হয়ে দাঁড়াবে। কেননা, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার মনে করে, রাশিয়ার গ্যাসই হলো জার্মানির কয়লাশক্তি থেকে বেরোনোর পাথেয়। গত মাসে অপ্রত্যাশিত রূঢ়ভাবে যুক্তরাষ্ট্র যে কোম্পানি এই পাইপলাইন বানাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ জারি করে। তখন থেকেই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস জোরের সঙ্গে বলে যাচ্ছেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে কী চমৎকার সম্পর্কই না আমরা গড়ে তুলেছি।’

নিশ্চিতভাবেই এই ডামাডোলে সবচেয়ে বড় বিজয়ী হলেন পুতিন। ব্যাপার হলো, রাশিয়া থেকে গ্যাস নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন দিয়ে বাল্টিক সাগর দিয়ে সরাসরি জার্মানিতে যাবে ঠিকই, কিন্তু এই পথ ইউক্রেনের মতো দেশের ওপর দিয়ে গেলেও ক্রেমলিন ঠিকই তাদের সরবরাহ কেটে দিতে পারবে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ইউক্রেনের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, এমনকি স্বাধীনতার ওপরও এটা সন্দেহের ছায়া ফেললেও বাইডেন প্রশাসন ভালো করেই জানে, তারা এই পাইপলাইন বন্ধ করতে পারবে না। তাই তারা ঠিক করেছে, এই প্রকল্পে রাজি হওয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের চীনা নীতিতে জার্মানির আরও সহযোগিতা আদায় করা হবে।

চীনের দিক থেকে মনে করা হয়, ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি পতনশীল অবস্থায় রয়েছে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় ইউরোপের প্রতি তাদের অসম্মানজনক আচরণে। এমনকি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডাচ সদস্যদের ওপর আলাদা করে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। জবাবে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট চীনা বিনিয়োগসংক্রান্ত একটি চুক্তির অনুমোদন আটকে দিয়েছে। অথচ এই চুক্তির ব্যাপারে তারা গত ডিসেম্বরেই রাজি হয়ে গিয়েছিল এবং চুক্তিটির ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের তরফে আলোচনা করে নেওয়ার অনুরোধও প্রকাশ্যে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।

চীনের এই কঠোর মনোভাব জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়কে এমন এক চুক্তির বিষয়ে উৎসাহিত করেছিল, যা কিনা পাশ্চাত্যকে ঐক্যবদ্ধ করবে। এর শর্তগুলো ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে: জার্মানি পাইপলাইন পাওয়ার পাশাপাশি তাদের কাঙ্ক্ষিত জলবায়ু নীতিও গৃহীত হবে; যুক্তরাষ্ট্র পাবে তাদের নতুন চীনা নীতি বাস্তবায়ন এবং আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পক্ষে জার্মানির সমর্থন।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নর্ড স্ট্রিম ২–এর বিষয়ে বাইডেনের ছাড়ের জন্য কোনো দাম চুকাতে হবে না। জার্মানি যেখানে পাইপলাইন প্রকল্প সম্পন্ন করার বিষয়ে কঠোর, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা পশ্চিমা জোটের মধ্যকার বিভক্তিকেই আরও বাড়াবে। ট্রাম্প প্রশাসন যেখানে হইচই করে চুক্তি করে তা ভুলে যায়, সেখানে বাইডেন প্রশাসন বাস্তবতা স্বীকার করে সেখান থেকে বাস্তব সুবিধা আদায় করে নিতে চায়।

বাইডেন প্রশাসন আত্মবিশ্বাসী যে পশ্চিমারা কেবল দেশটিকে সামাল দিতেই সক্ষম নয়, তারা একে চীনের কাছ থেকে সরাতেও সক্ষম। তারা পরিষ্কারভাবে দেখাতে চাইবে, চীনের ওপর উত্তরোত্তর নির্ভরশীলতা রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থের জন্যও ভালো নয়। সম্ভবত জেনেভায় পুতিনকে এই বার্তাই দেবেন বাইডেন।

জার্মানিকে পশ্চিমা জোটের মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথে চীনকে মোকাবিলাই হতে পারে বাইডেনের বিশাল পররাষ্ট্রনৈতিক অর্জন।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মেলভিন বি ক্রাউস নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর ইমেরিটাস