বাঙালির ইংরেজিয়ানা

‘টু-লেট: চেমি পাকা, ডাবল ও চিগেল ফেমিলি’, ‘ভাই ভাই ভাতের হোটেল অ্যান্ড মোরগ পোলাও রেষ্ঠুরেন্ড’—এই ধরনের সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনী পোস্টারে অলিগলির দেয়াল যখন সয়লাব, তখন বুঝতে বাকি থাকে না বাংলা ভাষার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। চিপাচাপা গলিতে লটকানো টিনের সাইনবোর্ডে ভুলভাল ইংরেজি কথা লেখা থাকে বাংলা অক্ষরে। আর গুলশান–বনানীর আলিশান ভবনের ডিজিটাল সাইনবোর্ডে ইংরেজি কথার পাশে যদি কোনো বাংলা নাম থাকেও সেটা বাংলা হরফে থাকে না। থাকে রোমান হরফে।

করোনাভাইরাসেরও টিকা পাওয়া গেছে, কিন্তু এই সব টাল্টুবাল্টু ইংরেজিয়ানার খোসপাঁচড়া থেকে বাংলা ভাষার ছালচামড়া বাঁচানোর প্রতিষেধক এখনো মেলেনি। গোটা সমাজের গা-গতরে গুটিবসন্তের মতো অহেতুক ইংরেজিয়ানা আরোপের রোগলক্ষণ ফুটে উঠছে। একটা সময় ছিল যখন কথার ফাঁকে ফাঁকে ‘সো’, ‘এনিওয়ে’, ‘বাট’, ‘বাই দ্য ওয়ে’ টাইপের ইংরেজি বুগনি গুঁজে দেওয়ার চল মহামারির মতো ছিল না। তখন দোকানপাট, হোটেল–রেস্তোরাঁ, অফিস–আদালতের নামফলকে ইংরেজির অত হম্বিতম্বিও ছিল না। কিন্তু কোত্থেকে কী হয়ে গেল! বাংলা হরফের নামফলক উঠে যাওয়া শুরু হলো। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র কায়দায় সাইনবোর্ড ঢেকে গেল রোমান হরফে।

এখন ভাবটা এমন দাঁড়িয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল বা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নামফলক রোমান হরফে না লিখলে আর জাত থাকছে না। মনে হচ্ছে ইংরেজিকে আমরা সবচেয়ে বড় ‘স্টেটাস সিম্বল’ হিসেবে নিয়েছি।

এখন ভাবটা এমন দাঁড়িয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল বা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নামফলক রোমান হরফে না লিখলে আর জাত থাকছে না। মনে হচ্ছে ইংরেজিকে আমরা সবচেয়ে বড় ‘স্টেটাস সিম্বল’ হিসেবে নিয়েছি। সেই সিম্বলকে বেশি সঙ্গী করতে গিয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক পরিসর যে কোণঠাসা হয়ে একেবারে দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে, সেদিকে নজর পড়ছে না। ইংরেজিকে বিলেতি সাহেবসুবোর ‘অতি সম্ভ্রান্ত অতিথি’ হিসেবে সম্মান করে বাংলার শীতলপাটি পাতা চৌকিতে শুতে দিয়েছিলাম। সেই অতিথি এখন বিছানা–বালিশ দখল করে বেচারা বাংলাকে ঠেলতে ঠেলতে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার অবস্থায় এনে ফেলেছে।

সাইনবোর্ডের নামফলকে পাইকারি হারে ইংরেজির ব্যবহার দেখে এক ভদ্রলোক আদালতের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আদালত বিদেশি দূতাবাস ও প্রতিষ্ঠান বাদে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, দপ্তরগুলোর নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর জের ধরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ড বাংলায় প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর অর্ধযুগ পার হয়ে গেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই কয় বছরে নতুন আরও কয়েক লাখ সাইনবোর্ড উঠেছে। এর বেশির ভাগেই হয় ইংরেজি নাম রোমান কিংবা বাংলা হরফে লেখা, নয়তো বাংলা নাম রোমান হরফে লেখা।
রাজধানীর যেকোনো সড়ক ধরে হাঁটা ধরুন। দেখবেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক ভূতের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ডে ইংরেজি মাতব্বরের মেজাজে বসে আছে। সবখানেই ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলকের ছড়াছড়ি। অবশ্য আদালতের নির্দেশের পর সরকারি দপ্তরের সাইনবোর্ড বা নামফলক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলায় বদলে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া যানবাহনের ডিজিটাল নম্বরপ্লেটগুলো বাংলায় সরবরাহ হওয়ার কারণে আদালতের নির্দেশ অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়েছে।

‘ভাইরে, আমার ব্র্যান্ডের নাম ইংরেজিতে, লোগো ইংরেজিতে, আমি এখন সাইনবোর্ড বাংলায় করব কেমনে?’ এই জবাব যথেষ্ট না এবং এর জন্য চাইলে সিটি করপোরেশন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু নেয়নি। নেয় না।

তবে বাস্তবতা হলো, ছয় বছরের বেশি সময় পার হলেও বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা নিয়ে আদালতের আদেশের বিষয়ে এখনো অনেকে জানেনই না। ব্যবসা সনদ বা ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার সময় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। ‘সাইনবোর্ড/ব্যানার বাংলায় লিখতে হবে’—এই কথাটি ব্যবসা সনদে আলাদাভাবে লেখা থাকে। কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে দিলেন কেন? এই প্রশ্ন করলে তার জবাবও তাঁরা ঠিক করে রেখেছেন: ‘ভাইরে, আমার ব্র্যান্ডের নাম ইংরেজিতে, লোগো ইংরেজিতে, আমি এখন সাইনবোর্ড বাংলায় করব কেমনে?’ এই জবাব যথেষ্ট না এবং এর জন্য চাইলে সিটি করপোরেশন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু নেয়নি। নেয় না।

নিজের হরফ বা লিপিতেই যেকোনো ভাষা তার আত্মপরিচয় বহন করে। বাংলার মতো দুনিয়ার এমন কোনো হরফ নেই যার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। সেই হরফের প্রতি এই বীতরাগ ‘ধম্মে সইবে না’। সন্তান বাংলা বলায় সড়গড় না হয়ে ইংরেজিতে কিংবা ইংরেজি অ্যাকসেন্টে বাংলা উচ্চারণ করলে শ্লাঘা অনুভব করা বাবা–মায়ের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। সন্তানের বাংলাচর্চায় তাঁদের না আছে উৎসাহ না আছে উদ্যোগ। অথচ আজ থেকে দুই শ বছর আগে উইলিয়াম কেরি নামের এক বিদেশি সাহেব বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র ও বাংলা বই পুস্তক মুদ্রণের জন্য পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে ছাপাখানা বসিয়েছিলেন। এখন আমরা আত্মবিস্মৃত বাঙালিরা পরের রঙে রং মেলাতে ব্যস্ত।

যে লোকটা নিজে উর্দুতে কথা বলতে পারতেন না, যাঁর ইংরেজিতে বলা কথা উর্দুতে তরজমা করে দেওয়ার জন্য একজন দোভাষী থাকত, সেই জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেদিন আমরা বাংলা হরফের অসম্মান মানিনি। আজ প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল পর সেই বাংলা লিপিকে দায়সারা মর্যাদা দিচ্ছি।

ধরুন, আপনি একটি বহুজাতিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চান। আপনার হাতে ঋণ নেওয়ার শর্ত সংবলিত কয়েক পাতার একটি বিরাট দলিল ধরিয়ে দেওয়া হবে। যেহেতু আপনাকে ঋণটা শোধ করতে হবে, সেহেতু কথাগুলো আপনার ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। কিন্তু সেই শর্তাবলি ও ফরম থাকবে ইংরেজি ভাষায়। ওদিকে ইংরেজি আপনি খুব ভালো জানেন না। ঋণ নেওয়ার কয়েক মাস পরে যখন খটকা লাগবে, যখন মনে হবে ‘ব্যাংকের সঙ্গে এ রকম তো কথা ছিল না!’ তখন ব্যাংক বলবে, ‘এ রকমই কথা ছিল। আপনি সব পড়ে সই করেছেন।’

এইভাবে বাংলার ওপর বিদেশি ভাষার, বিশেষত ইংরেজির আগ্রাসন আমরা মেনে নিচ্ছি। পৌনে এক শতাব্দী আগে যে লিপির মান বাঁচাতে আমাদের জান দিতে বাধেনি, আজ সেই লিপিকে গর্বের সঙ্গে নামফলকে ঠাঁই দিতে আমাদের বাধছে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]