বাজেটে গুণগত ব্যয়ের ওপর জোর দিতে হবে

করোনায় এবারও বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে

করোনার প্রভাবে গেল বছরের মতো এবারও বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। ব্যাহত হচ্ছে অর্থ ব্যয়ের স্বাভাবিক গতি। ফলে ব্যাপক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি শতভাগ বাজেট বাস্তবায়ন। পত্রিকা থেকে জানা গেছে, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাজেট থেকে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাজেট বাস্তবায়নের হার মাত্র ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এটা হতাশাজনক। সন্দেহ নেই, অর্থ ব্যয়ে এ শ্লথগতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

চলতি বাজেট ঘোষণাকালেও করোনা ছিল। আগে থেকেই তাই বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করে আসছিলেন বিশ্লেষকেরা। সে জন্য বাস্তবমুখী বাজেট ঘোষণার ওপরও জোর দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সরকারের দিক থেকে তেমন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। অনেকটা আগের ধারাতেই উচ্চাভিলাষী বাজেটই ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী। প্রথম আট মাসে বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতি পূর্বোক্ত ধারণারই প্রতিফলন। করোনাকালে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রনীতি নেওয়া হলেও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দের ৮৫ শতাংশ খরচ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে সে অনুযায়ী খরচ করতে পারছে না বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। মূলত উন্নয়ন খাতে তুলনামূলক ব্যয়েরই প্রভাব পড়েছে বাজেটে।

করোনা সংকটের কারণে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের জন্য চলতি বছর বেশ চ্যালেঞ্জিং। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবির। বেসরকারি বিনিয়োগ শ্লথ। ব্যক্তি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যয়সংকোচন বা কৃচ্ছ্রসাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিপুলসংখ্যক লোক বেকার ও দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে গেছে। গত বছর অঘোষিত লকডাউনে অনেক মানুষ কাজ ও আয় হারিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই পুনরায় কাজে যোগ দিতে পারেননি। এর মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় চলছে একধরনের লকডাউন। আরেক দফা কাজ হারিয়েছেন মানুষ। বিপুল শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর আয়-উপার্জন নেই। ফলে ভোগব্যয়েও মন্থরতা বিরাজ করছে। বলা চলে, নানা দিক থেকে বর্তমানে অর্থনীতি সংকুচিত। স্বস্তির বিষয়, সরকার প্রায় ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের কাছে নগদ অর্থ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আইএমএফের বরাতে এটাও জানা গিয়েছে, সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে জিডিপি অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় বাজেট বাস্তবায়নে গতি সঞ্চার করতে না পারলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।

করোনাকালীন মন্দা মোকাবিলায় অনেক দেশেই ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস প্রণীত মডেল অনুসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থপ্রবাহ অব্যাহত রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের ব্যয় বাড়ছে। বাইডেন প্রশাসন সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে ইতিমধ্যেই অর্থনীতিতে প্রণোদনা সৃষ্টি করতে পেরেছে। আরও ব্যয়ের সুপারিশ আসছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থাগুলোও এর ওপর জোর দিচ্ছে। এ সময়ে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি হলেও সমস্যা দেখছে না আইএমএফ। মোদ্দা কথা, নানাভাবে সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে ভোগচাহিদা ও অর্থনীতির গতিময়তা বজায় রাখতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিপরীত প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নানা প্রণোদনা ও দরিদ্রদের সহায়তা কর্মসূচি বিন্যাস করা হয়েছে বটে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তার উপর আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়নও করা যাচ্ছে না। এমন এক প্রেক্ষাপটে কার্যকরভাবে বাজেট বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। নানা সমালোচনা সত্ত্বেও উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণার পেছনে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নে শ্লথগতির কারণে সে উদ্দেশ্যও অনেকখানি ব্যাহত হচ্ছে। একে তো সরকারি সহায়তার পরিমাণ অপ্রতুল, তার মধ্যে বাজেট বাস্তবায়নে চলমান স্থবিরতা বজায় থাকলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো অনেক দুরূহ হবে।

সবাই জানি, চলতি অতিমারি আমাদের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ হলো দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান। আগের জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ বা সাড়ে তিন কোটির সঙ্গে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র যোগ হয়েছে। সেই হিসাবে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি।

অন্যদিকে আগে থেকেই দেশে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি হতাশাজনক, বিশেষ করে তরুণ বেকারত্ব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিগত বছরগুলোয় জোরালো প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান ছিল সীমিত, যাকে অনেকেই কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলছেন।করোনাকালে আনুষ্ঠানিক খাতের অনেক কর্মী কাজ হারিয়েছেন। পাশাপাশি বিরাট অনানুষ্ঠানিক খাত তো রয়েছেই। ফলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী।

এ দুটি চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি ন্যূনতম গুণমান বজায় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন করাও জরুরি। অর্থনীতি ও জননীতিবিদদের অনেকের মতে, বাজেট ব্যয় মানেই রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। এতে দেশের অভ্যন্তরে অর্থপ্রবাহ বাড়ে, সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ। বলা চলে, অর্থনীতিতে গুণক (মাল্টিপ্লায়ার) প্রভাব পড়ে। কাজেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বাজেট বাস্তবায়নকে বেগবান করতে হবে।

সত্য যে বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে রাজস্বের একটা সংযোগ আছে। দুঃখজনকভাবে রাজস্ব আহরণে বাংলাদেশ বরাবরই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ১৯ শতাংশ, ভুটানের কর-জিডিপি অনুপাত ১৬ শতাংশ, ভারতের ১২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১১ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং মালদ্বীপের অনুপাত ৯ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ এত উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যেও বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ৮ শতাংশের মতো। এর মধ্যে করোনার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির গতি ফিরে না আসায় রাজস্ব আদায় আরও কম হচ্ছে। ফলে সার্বিকভাবে অর্থ ব্যয়ের গতিও কম। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে অর্থনীতিবিদেরা এ জন্য অনেক দিন ধরেই কর হার কমিয়ে কর ভিত্তি সম্প্রসারণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এটা আমলে নিয়ে কর কাঠামোয় ব্যাপক সংস্কারও জরুরি।

তবে কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় কম হলেও বৈদেশিক উৎস থেকে অনেক অর্থ পাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের ইআরডি এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ জন্য ধন্যবাদও দিতে হয়। পাশাপাশি ৪৫ বিলিয়ন ডলারের উচ্চ রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার নিয়েও আছে তর্কবিতর্ক। তাই সব দিক বিবেচনা করে বহুবিধ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন বাড়াতে হবে। তার সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং নজরদারি। নইলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে না। সাধারণ মানুষের জীবন অস্বাভাবিক চাপেই রয়ে যাবে।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক