বাণিজ্য বিরোধ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি

বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে

চার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ভারত বাংলাদেশি পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং বা ডাম্পিং-নিরোধী শুল্কারোপ করেছে। এর ফলে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পাটের সুতা, পাটের বস্তা ও চট রপ্তানি অনেক কমে গেছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা ও দেনদরবার করেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। সর্বশেষ চলতি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেছিল বাংলাদেশ, কিন্তু কোনো সুবিধা হয়নি। ভারতীয় পক্ষ বরং সান্ত্বনা দেওয়ার মতো জানিয়েছে যে তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবে।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিন ধরনের বাংলাদেশি পাটপণ্যের ওপর প্রতি টনে সর্বনিম্ন ১৯ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৩৫২ ডলার হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করে ভারত। ভারতীয় পাটপণ্য উৎপাদকেরা অভিযোগ করেছিলেন যে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা নিজ দেশের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দরে এসব পণ্য ভারতে রপ্তানি করে থাকেন। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া ভর্তুকি সুবিধার ব্যবহার করেন তাঁরা। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে দুটি বাদে সব পাটকলের উৎপাদিত এসব পণ্য রপ্তানির ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করে ভারত সরকার।

অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অনুমোদিত একটি বাণিজ্য প্রতিবিধান ব্যবস্থা। একটি দেশ আরেক দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অন্যায্য বা অসাধু চর্চার শিকার হলে এবং সে কারণে আমদানিকারক দেশে ওই পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হলে এই প্রতিবিধানের আশ্রয় নেওয়া যায়। এ জন্য ডব্লিউটিওর বিধিবিধান অনুসরণ করতে হয় এবং ডাম্পিং বা নিজ দেশের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দরে পণ্য রপ্তানি প্রমাণিত হলে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করা যায়।

ভারত শুধু পাটপণ্যেই নয়, বাংলাদেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ও মাছ ধরার জালের ওপরও অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করেছে ২০১৭ সালেই। পাকিস্তানও বাংলাদেশি হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করেছে। তবে চার বছরেও বাংলাদেশ পাটপণ্যের ওপর ভারতের আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যদিও অনেক কথাবার্তা হয়েছে এ নিয়ে।

কোনো পণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করা হলে প্রথমেই নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করতে হয় যে এই শুল্কারোপ প্রক্রিয়ায় ডব্লিউটিওর বিধিবিধানগুলো কতটা অনুসৃত হয়েছে। বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা ডাম্পিং করেননি, এটা দেখানো এখন জরুরি নয়। জরুরি হলো, ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ প্রক্রিয়া যে ত্রুটিপূর্ণ, তা প্রমাণ করা। এটি কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে একবার প্রমাণ করে ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি শাখায় (ডিএসবি) তুলে ধরলে ভারতকে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

অবশ্য ডব্লিউটিওর দ্বারস্থ হওয়ার জন্য প্রয়োজন বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করার সদিচ্ছা। এ বাংলাদেশের জন্য অর্থ ব্যয় এখন আর বড় বাধা নয়, বড় বাধা সম্ভবত ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মনস্তত্ত্ব। ডব্লিউটিওতে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার মানে হলো, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিরোধকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এতে বাংলাদেশ ও ভারতকে আন্তর্জাতিক আধা বিচারিক কাঠগড়ায় পরস্পরের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য বিষয়টি সম্ভবত খুব স্বস্তিদায়ক নয়। কিন্তু এটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাণিজ্য বিরোধের ফয়সালা করা না গেলে বিদ্যমান বৈশ্বিক বাণিজ্য আইনি কাঠামোতে তা করার অধিকার ডব্লিউটিওর সদস্য যেকোনো দেশেরই আছে। বাংলাদেশ সে অধিকার প্রয়োগ করতেই পারে, যেমনটি প্রায় দুই দশক আগে করেছিল ড্রাইসেল ব্যাটারি রপ্তানির ওপর ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং পদক্ষেপ চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য বিষয়টি সম্ভবত খুব স্বস্তিদায়ক নয়। কিন্তু এটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাণিজ্য বিরোধের ফয়সালা করা না গেলে বিদ্যমান বৈশ্বিক বাণিজ্য আইনি কাঠামোতে তা করার অধিকার ডব্লিউটিওর সদস্য যেকোনো দেশেরই আছে। বাংলাদেশ সে অধিকার প্রয়োগ করতেই পারে, যেমনটি প্রায় দুই দশক আগে করেছিল ড্রাইসেল ব্যাটারি রপ্তানির ওপর ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং পদক্ষেপ চ্যালেঞ্জের মাধ্যম

ভারত যখন আটঘাট বেঁধে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করেছে, তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের অনুরোধ বা দেনদরবারে এটা প্রত্যাহার করা হবে না। নিজ দেশের স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ভারত বৈশ্বিক বাণিজ্য আইনের আওতাতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এদিকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনুরোধ-আবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত কালক্ষেপণই করেছে। আবার এই অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের মেয়াদ পাঁচ বছর। এর মধ্যে চার বছরের বেশি সময় ফুরিয়ে গেছে। বাকি নয় মাসে কিছু না করলেও ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে এই শুল্কের কার্যকারিতা শেষ হবে। তারপর যদি তা আবার মেয়াদ বাড়ানো না হয়, তাহলে বাংলাদেশি পাটপণ্য আবার শূন্য বা নিম্ন শুল্ক দিয়ে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। তখন হারানো বাজার কতটা পুনরুদ্ধার করা যাবে, সে প্রশ্ন অবশ্য থাকছে।

মোট রপ্তানির তুলনায় ভারতে পাটপণ্যের রপ্তানির পরিমাণ যা–ই হোক না কেন, অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ককে চ্যালেঞ্জ করে ডব্লিউটিওর দ্বারস্থ না হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশি পাটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকেরা ভারতে ডাম্পিং করেছেন। পাশাপাশি বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এটি অন্য বাণিজ্য অংশীদারদেরও সুযোগ পেলে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করতে পারে।

যেমন ফেব্রুয়ারি মাসেই ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর সুরক্ষা শুল্কারোপের (সেফগার্ড ডিউটি) ঘোষণা দিয়েছে। প্রতি পিসে সর্বনিম্ন ৩৮ সেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ২৯ ডলার পর্যন্ত বিভিন্ন হারে এই সুরক্ষা শুল্কারোপ করা হয়েছে মোট তিন বছরের জন্য। এরপর অবশ্য গত ১৬ মার্চ ঢাকা ও জাকার্তা এ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসেছিল। এতে ফল কী হবে, তা এখন দেখার বিষয়। তবে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসা নিশ্চিত হওয়ার সময়কালে বাণিজ্য অংশীদারদের নেওয়া একের পর এক বাণিজ্য প্রতিবিধানমূলক পদক্ষেপ আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের বাণিজ্য বিরোধ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।

আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]