বাতিল সম্মেলন কী বার্তা দিচ্ছে

পাকিস্তানের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৯৭১ সালবিষয়ক একটি একাডেমিক সম্মেলন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। ২৩ মার্চ থেকে পাঁচ দিন এ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ভার্চ্যুয়ালি, আয়োজন করেছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজম্যন্ট সায়েন্সেসের স্কুল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স (লামস)। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পাকিস্তান স্টাডিজ। এতে দক্ষিণ এশিয়ার, বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকজন গবেষকের যোগ দেওয়ার কথা ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা নিয়ে এ আলোচনা অনুষ্ঠান বিষয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকলেও উদ্যোক্তারা এর ঘোষণা দেন ১৯ মার্চ। কিন্তু ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টাও পার হয়নি, উদ্যোক্তাদের ওপর এমন চাপ তৈরি হয়েছিল যে তাঁরা এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঝুঁকি নিতে পারেননি। লামসের পক্ষ থেকে যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে চাপের কথা বলা হয়নি, কিন্তু যাঁরা টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিক মিডিয়া অনুসরণ করেন, তাঁরা জানেন যে এ সম্মেলনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আক্রমণাত্মক প্রচারণা শুরু হয়েছিল।

পাকিস্তানের এ ঘটনা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যে অসহিষ্ণুতার ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ এটি। এ ধরনের উদাহরণ আছে অসংখ্য। একে কেবল পাকিস্তানে সংঘটিত একটি ঘটনা বলে বিবেচনা করলে হবে না। বাংলাদেশ কিংবা অন্য যেকোনো দক্ষিণ এশীয় দেশে যাঁরা এ ঘটনা লক্ষ করছেন, দুটি বিষয় তাঁদের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত, দেশের ইতিহাসের সরকারি বা অফিশিয়াল ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করা যে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় সেটা। দ্বিতীয়ত, যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন এ ন্যারেটিভ চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করবে, তাদের চুপ করিয়ে দেওয়ার কাজটি, তাদের ওপর সেন্সরশিপ আরোপের কাজটি, কার্যত ফ্রাঞ্চাইজ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তা তুলে দেওয়া হয়েছে সরকারি এবং প্রচলিত ভাষ্যের সমর্থক ব্যক্তি ও সংগঠনের ওপর।

পাকিস্তানের এ ঘটনার কুশীলব কারা? সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ চাপ ছিল কি না, তা জানা না গেলেও সরকার যে এতে অখুশি, তা মনে করার কারণ নেই। পাকিস্তানের এস্টাবলিস্টমেন্ট, বিশেষ করে সেনাবাহিনী, যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এবং সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যাকে হয় এড়িয়ে যায় বা তাদের সাজানো গল্পে ভোলাতে চায়, তা সবার জানা। ১৯৭১ সালকে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যার এ প্রবণতা এতটাই প্রবল যে এমনকি তা পাকিস্তানের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও প্রকাশিত। ২০১০ সালে পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকগুলো ভালো করে দেখার সুযোগ হয়েছিল, সেই সময় বিস্মিত না হলেও জেনেছি যে পাকিস্তানি নবম-দশম শ্রেণির শিশুদের ভয়াবহ মিথ্যাচার শেখানো হচ্ছে, উল্লেখ নেই বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার। এ কাজ রাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই হয়ে এসেছে।

খুরশিদ কামাল আজিজ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ দ্য মার্ডার অব হিস্ট্রিতে দেখান যে কী করে পাকিস্তানে ইতিহাসকেই হত্যা করা হচ্ছে প্রতিদিন। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে গবেষণা করেছেন ইভেট ক্লেয়ার রসার; ২০০৩ সালে তিনি এ বিষয়ে তাঁর পিএইচডি গবেষণা শেষ করেন। জাতীয় পরিচয় গঠনে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা, এগুলোতে কীভাবে তথ্যকে সাজানো হয় এবং এগুলো কী করে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী করা হয়, তা তিনি দেখিয়েছেন। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধ’ই একমাত্র বিষয় নয়, কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানের ইতিহাসও একই ব্যাপার। ২০১৫ সালে এ লামস-কেই সরকারের চাপের মুখে বেলুচিস্তানবিষয়ক সম্মেলন বাতিল করতে হয়েছিল।

সরকার যেমন প্রত্যক্ষভাবে সেন্সরশিপ করে, তেমনি তার সমর্থক গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করে, যেন তারাই এ কাজ করে দেয়। এটি পাকিস্তানে যেমন ঘটে, ভারতেও; ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ঘটছে অহরহ। সেমিনারে বক্তাদের আসতে ভিসা না দেওয়া এবং দেশের বক্তাদের ওপর বিজেপি–সমর্থকদের চড়াও হওয়ার ঘটনার উদাহরণ আছে অসংখ্য। এ বছরের জানুয়ারি মাসে মোদি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন আন্ডার সেক্রেটারি একটি মেমোতে জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ সংস্থান করা হয়, সহজ ভাষায় যেগুলো পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেগুলো যদি আন্তর্জাতিক কোনো ওয়েবিনারের আয়োজন করে, তবে উদ্যাক্তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। কোন কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য এ ধরনের অনুমোদন লাগবে, তার একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা, সীমান্ত, উত্তর–পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো, ইউনিয়ন জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ এবং অন্যান্য বিষয়, যেগুলো ‘সুস্পষ্ট এবং নির্ভেজালভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’।

ভারত ও পাকিস্তানের এসব ঘটনা কেবল একাডেমিক ফ্রিডম বা বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপই নয়, সে ধরনের ঘটনা তো এখন গা সওয়া হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের সরকারি ভাষ্যকে একমাত্র ভাষ্যে পরিণত করার চেষ্টা। বাংলাদেশে এ প্রবণতার বহুবিধ লক্ষণ স্পষ্ট। আইনি ব্যবস্থার মধ্যে সহজেই উল্লেখ্য হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২১ ধারা। কিন্তু একটি বিশেষ আইনই কেবল মতপ্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করে তা নয়, ক্ষমতাসীন দল এবং তার সমর্থকেরা এর বাইরেও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করে ভীতিকর পরিস্থিতির সূচনা করতে পারেন, যেকোনো ভিন্নমতকে দমিয়ে দিতে পারেন এবং ভিন্নমতাবলম্বীকে হেনস্তা করতে পারেন। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁরা জানেন এগুলো কতটা ভয়াবহ। অন্যরা এ আশঙ্কায় নীরবতাকেই বেছে নেন।

ভারতে গেরুয়া বাহিনীর সাজানো ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজটি বুদ্ধিজীবী, লেখক ও গবেষকেরা করে যাচ্ছেন, তাঁদের এ কাজ খুব সহজ নয়। প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই তাঁরা তা করছেন। পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে সরকারি এবং এস্টাবলিশমেন্টের ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করার ঘটনা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে, প্রগতিশীল লেখক-সাংবাদিক-গবেষকেরা এ বিষয়ে কথা বলছেন। তাঁদের অবস্থা যে কতটা নাজুক, সেটা সাম্প্রতিকতম সম্মেলন বাতিল করতে বাধ্য হওয়ার ঘটনায় আরও সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এগুলো থেকে এটাও শেখার বিষয় যে চিন্তাশীল এবং সক্রিয় মানুষের এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট