বাম-কংগ্রেস জোট: দুঃস্বপ্নে মমতা

প্রচারের ধরনই বদলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনকে নিয়ে এখন প্রচারের ময়দানে মমতা। প্রতিদিনই ছুটছেন রাজ্যের এ– প্রান্ত থেকে ও–প্রান্ত। লক্ষ্য একটাই, এবারেও জিততে হবে তাঁর দলের। পরাস্ত করতে হবে বিরোধীদের। ২০১১ সালের নির্বাচনে ১৮৪ আসন পেয়েছিলেন তিনি। এবার চাইছেন আরও বেশি। চাইছেন না বিরোধীদের একটি আসনও ছাড়তে। তাঁর মন্ত্রিসভার কতক মন্ত্রী তো রোজই ঘোষণা দিচ্ছেন এবার বিরোধীশূন্য হবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। কিন্তু পারবেন কি? গত বিধানসভা নির্বাচনে ৪২টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। আর বাম দল পেয়েছিল ৬০টি আসন। এবার সেই হিসাবকেই পাল্টে দেওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়েছেন মমতা। প্রশ্ন উঠে এসেছে রাজনীতির অন্দর থেকে সত্যি কি মমতা এবার একা লড়ে পরাস্ত করতে পারবেন বাম-কংগ্রেস জোটকে? এ নিয়ে বিতর্কের অভাব নেই। বাম-কংগ্রেস জোটের নেতারাও মাঠে নেমে হুংকার ছেড়েছেন নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলে মমতার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। মমতা হারবেনই। তবে মমতা হারবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে এ কথা প্রকাশ পেয়েছে, কমছে মমতার আসন। তবে টেনেটুনে শেষ পর্যন্ত হয়তো জিতেও যাবেন। তবে মমতার এই জয়ের পথ এবার কিন্তু গত নির্বাচনের ন্যায় মসৃণ নয়।
মমতার এবারের প্রচারে একটি দিক লক্ষ করা গেছে, তা হলো মমতা এবার নির্বাচনের প্রধান অস্ত্র করেছেন বাম-কংগ্রেস জোটকে। প্রতিটি জনসভায় তিনি অস্ত্র শাণাচ্ছেন বাম-কংগ্রেস জোটকে। এ জোট অনৈতিক, স্বার্থের জোট। এই জোট এবার কিছুই করতে পারবে না। মানুষ দুহাত ভরে ভোট দেবে তৃণমূলকে। মমতার এই যে বাম-কংগ্রেস জোট দিয়ে এত সমালোচনা, এত কটাক্ষ তার পেছনে কিন্তু আরেকটি রাজনৈতিক অঙ্ক রয়েছে। মমতা তাঁর সরকারের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে জেনেছেন, বাম-কংগ্রেস জোট হলে তাঁর দলের আসন কমবে। এই চিন্তাই এখন মমতার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলেছে। তাই যেনতেন প্রকারে প্রতিটি প্রচার সভায় একহাত নেন বাম-কংগ্রেস জোটকে। যদিও বাম-কংগ্রেস জোটের নেতারাও বলেছেন, মমতা বুঝে নিয়েছেন এবার আর অত সহজে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যাবে না। পার হতে গেলে অনেক শ্রম দিতে হবে। তাই তো মমতা বিভিন্ন জনসভায় বলে বেড়াচ্ছেন, কংগ্রেস কর্মীরা ভাবুন, এই সিপিএমের বিরুদ্ধে একদিন আপনারা লড়াই করেছেন, সিপিএমের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছেন, আজ কেন আপনারা ওদের সঙ্গে থাকবেন? আমিও তো একদিন কংগ্রেস করতাম। কিন্তু কংগ্রেস যখন সিপিএম ঘেঁষা হতে থাকে, তখন আমি দল ছেড়ে নতুন দল তৃণমূল গঠন করি। তাই আপনারাও ভাবুন। এসব কথার মাঝে মমতা এমনও ইঙ্গিত দেন ফিরে আসুন তৃণমূলে। পরিত্যাগ করুন সিপিএমকে।
কংগ্রেস-বাম জোটের মাঝে ফাটল ধরাতে মমতা এখন মাঠে নেমে পড়েছেন। যদিও এতে আমল দিচ্ছে না বাম-কংগ্রেস জোটের নেতারা। তাঁদের একটিই দফা, মমতাকে হারানোর। এই দাবিতে উভয় দলই এককাট্টা। এদিকে বিভিন্ন আসনে দুই দলের প্রার্থী থাকায় অনেকটা অস্বস্তিতে রয়েছে দুই দলই। তবু দুই দলের তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে অচিরেই মিটে যাবে এই সমস্যা। আমরা এক আসনে এক প্রার্থী দেব। আমাদের মূল লক্ষ্য এই রাজ্যপাট থেকে তৃণমূলকে হটানো। রাজনৈতিক মহলে একটা প্রশ্ন উঠেছে কেন মমতা এত বিরোধিতায় নেমেছে এই বাম-কংগ্রেস জোট নিয়ে? মমতাও তো ২০১১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে নেমেছিলেন। জয়ী হয়েছিলেন। হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীও। সেই মমতা এত খেপে আছেন কেন কংগ্রেসের ওপর? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মমতা বুঝে নিয়েছেন এবার আর তাঁর জয়ের পথ এত সহজ হবে না।
মমতার ভোটে ভাগ বসাতে চলেছে কংগ্রেস ও বিজেপির একাংশ। তাই ভোট ভাগ হলে আখেরে সমস্যায় পড়বেন মমতা। কারণ, মমতার বিরুদ্ধে এখন এক হয়েছে বাম দল, কংগ্রেস ও প্রকারান্তরে বিজেপিও। অথচ এই মমতা কিন্তু বিজেপির গড়া এনডিএ জোটে ছিলেন একসময়। দুবার তিনি ওই জোটে থেকে মন্ত্রীও হয়েছেন। একবার রেলমন্ত্রী ও অন্যবার কয়লামন্ত্রী। শুধু কি তাই, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএর সঙ্গে জোট করে নির্বাচনও করেছেন মমতা। এ তো গেল বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার কথা। মমতা আবার শরিক হয়েছিলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বে গড়া ইউপিএ জোটে। ওই জোটে থেকেও তিনি কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন।
একসময় বিজেপি ও কংগ্রেস জোটে থেকেও আজ মমতা বাম-কংগ্রেস জোটের বিরোধিতায় নেমেছেন। কিন্তু কেন? রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, মমতা পাঁচ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, এটা ঠিক। পাশাপাশি তাঁর আমলে অবনতি ঘটেছে আইনশৃঙ্খলার। বেড়েছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। বাড়ন্ত হয়েছে অপরাধীরা। তারাও শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকারি দলকে। বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। ফেরত দিতে পারেননি সিঙ্গুরের টাটার অধিকৃত জমিকে অনিচ্ছুক কৃষকদের হাতে। এসব কারণেই মমতার জনপ্রিয়তায় কিছুটা হলেও ভাটার টান পড়েছে। আর এসব উপলব্ধি করেই মমতা এবার তাঁর নির্বাচনী প্রচারের মূল অস্ত্র করেছেন বাম-কংগ্রেস জোটকে।
মমতা জানেন, এই জোট তাঁদের কাছে বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি কংগ্রেস ও বাম দল পৃথকভাবে নির্বাচন করে, সে ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই জয় পেতেন মমতা। কিন্তু এবার তা হতে পারেনি। জোট গড়ার আগে মমতা এই বাম-কংগ্রেস জোটের বিরুদ্ধে অস্ত্র শাণিয়েও ভালো ফল আদায় করতে পারেননি। তাই মমতার এত গোসসা বাম-কংগ্রেস জোটকে নিয়ে। এর কারণ আরও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলা এখনো কংগ্রেসের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এসব জেলায় অবশ্য মমতার হুল ফোটানো কঠিনই হবে।
গত নির্বাচনে মুর্শিদাবাদের ২২টি আসনের মধ্যে ১৪টি কংগ্রেস ও ৭টি বাম দল পেয়েছিল। মালদহে ১২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৮টি ও বাম দল ৩টি আসন পেয়েছিল। উত্তর দিনাজপুর জেলার ৯টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪টি ও বাম দল ৩টি আসন পেয়েছিল। অনুরূপভাবে কোচবিহার, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বীরভূমে রয়েছে আবার বাম দলের প্রভাব। দার্জিলিংয়ে রয়েছে জনমুক্তি মোর্চার প্রভাব। আর এটা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন মমতা। তাই আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। আর কড়া সমালোচনা করছেন বাম-কংগ্রেস জোটকে। তবু রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এমনটা এখনো মনে করছেন না যে মমতা সত্যিই হেরে যাচ্ছেন। তবে এটুকু তাঁরা বুঝেছেন মমতার আসন কমবে। মমতা যতটা আসন পাবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন, সেই আসন না-ও পেতে পারেন। কারণ, এই বাম-কংগ্রেস জোটই এখনো তাঁর পথের বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মমতার লক্ষ্য এখন এই বাধা সরিয়ে তাঁর দলকে এগিয়ে নেওয়া।
অমর সাহা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।