বিউটেনিসের মন্তব্যকে নেতা-নেত্রীরা কীভাবে নেবেন

শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা বলে থাকেন, মাঠে আন্দোলন করতে না পেরে বিএনপির নেতারা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। দেশের সমস্যা নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেওয়া মোটেই গৌরবের নয়। অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই ক্ষমতায় যেতে ও থাকতে বিভিন্ন সময়ে বিদেশিদের শরণাপন্ন হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি কমনওয়েলথ প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান ও ২০১৩ সালের শেষ দিকে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারানকোর ‘ব্যর্থ সংলাপের’ কথা আমরা ভুলে যাইনি। প্রথমটি হয়েছিল বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে, দ্বিতীয়টি আওয়ামী লীগের শাসনামলে। তবে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া শুরু আশির দশক থেকেই।

বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে রাজনীতিকদের ধরনার বিষয়টি আগে লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যেত। ২০১০ সালে ওয়েবসাইট উইকিলিকসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের গোপনীয় তথ্য ফাঁস হওয়ার পর কে কোথায়, কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কোন নেতা কোন কূটনীতিককে কী পরামর্শ দিয়েছেন, তা বেরিয়ে আসছে। ২০১৩ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত উইকিলিকসে বাংলাদেশ নামের একটি বইয়ে ২০০৭-২০০৮ সালের জরুরি অবস্থাকালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো অনেক তারবার্তার অনূদিত ভাষ্য ছাপা হয়েছে। এসব তারবার্তা প্রমাণ করে যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার ছিলেন, ক্ষমতাধর দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য বিদেশি কূটনীতিকেরাও অনেক সময় রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন, এটি তাঁদের কূটনৈতিক দায়িত্ব। বিপরীতে আমাদের রাজনীতিকেরা সব সময় রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিসের যে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, তা রাজনীতিকেরা কীভাবে নেবেন জানি না, নাগরিক হিসেবে আমরা লজ্জাবোধ করি। রাজনীতিকদের রেষারেষি, আন্তদলীয় ও অন্তর্দলীয় বিবাদ বিদেশি কূটনীতিকদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বিদেশি পত্রিকার মুখরোচক শিরোনাম ছিল, ‘দুই বেগমের লড়াই’।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদ যে দুই দল ও দুই নেত্রীর মধ্যে সীমিত নয়, তার প্রমাণ আমরা পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পাই। এক নেতার বিরুদ্ধে আরেক নেতা, এক সংগঠনের বিরুদ্ধে আরেক সংগঠনের প্রকাশ্য বিষোদ্‌গার রীতিমতো গালাগালিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব পাল্টাপাল্টি বিবৃতির ঝড় বইছে, তা শুনলে শ্রবণযন্ত্র বন্ধ করে দিতে হয়।

রাজনীতিকদের রেষারেষি, আন্তদলীয় ও অন্তর্দলীয় বিবাদ বিদেশি কূটনীতিকদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বিদেশি পত্রিকার মুখরোচক শিরোনাম ছিল, ‘দুই বেগমের লড়াই’।

রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের লড়াই থাকবে, মত-দ্বিমত থাকবে, কিন্তু সেসব প্রকাশের ভাষা এত নোংরা হবে কেন? কেন একজন রাজনীতিক বা ধর্মীয় নেতা প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতে গিয়ে অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করবেন? মানুষ যখন যুক্তিবুদ্ধি ও হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তখনই চড়া গলায় গালাগাল করে। যুক্তি ও আদর্শ যখন প্রধান হয়, তখন গালাগালের প্রয়োজন হয় না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কঠোরতম ভাষায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও হত্যার প্রতিবাদ করেছেন। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি ২৪ বছরের বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস বলেছেন, শত্রুকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, জনগণকে তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন; কিন্তু কেউ আপত্তি বা আহত বোধ করতে পারেন, এ রকম একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিসের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তিনি ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব ছিলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময় থেকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুর কয়েক মাস।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসোসিয়েশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ওরাল হিস্টোরি প্রোগ্রামে চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কাটানো সময়টা ছিল দারুণ। আমি বাংলাদেশের জনগণের খুব প্রশংসা করি। কিন্তু রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সেটা করতে পারি না।’ তাঁর মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড ছিল তাঁর জন্য বিব্রতকর। সবাই তাঁকে রাজনীতিতেও জড়িয়ে ফেলতে চাইত। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০)

বিউটেনিস আরও বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতারা অব্যাহতভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং তাঁদের অবস্থানের বিষয়ে কোনো না কোনো সমর্থন-সহযোগিতা চাইতেন। এমনটি সব দেশে হয় না। অনেক সময় আমাকেও শুনতে হতো ‘দয়া করে প্রধানমন্ত্রীকে এটি বলুন’ বা ‘দয়া করে বিরোধী দলকে এটি বলুন’। পূর্বসূরি হ্যারি কে টমাসের বরাত দিয়ে বিউটেনিস বলেছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মানে রাজা। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আরও অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতেরা বাংলাদেশে এসে নিজেদের রাজা মনে করেন। তাঁদের সেই সুযোগটি করে দিয়েছেন আমাদের রাজনীতিকেরাই।

উইকিলিকসে বাংলাদেশ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালের ৭ নভেম্বরের তারবার্তায় প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস লেখেন, তিনি (রাষ্ট্রদূত হিসেবে) ও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকর্তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু আজিজ তাঁর পদ আঁকড়ে থাকার বিষয়ে ছিলেন অনড়।

১০ ডিসেম্বর পাঠানো তারবার্তায় বলা হয়, ওই দিনই রাষ্ট্রদূত (বিউটেনিস) ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উদ্দেশ্য, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের জন্য সমঝোতার মনোভাব সৃষ্টি। পরের মাসে তাঁরা আবার দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।

৭ জানুয়ারির তারবার্তায় তিনি লিখেছেন, রাষ্ট্রদূত ও আনোয়ার চৌধুরী ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে জানান যে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কয়েকজন নেতা তাঁদের কাছে এসেছিলেন এমন রাজনৈতিক পরিবেশের সুপারিশ নিয়ে, যার মধ্যে আছে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বিদেশে নির্বাসন পাঠানো ও সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ। দুই কূটনীতিক অচলাবস্থা নিরসনে দুই নেত্রীর সাহসী পদক্ষেপ আশা করেন। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ জাতিসংঘের দ্বারা কার্যকরভাবে পরিচালিত নির্বাচন চায় বলেও তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়। ২০১৩ সালে বিএনপিও অনুরূপ দাবি করেছিল।

৯ জানুয়ারির তারবার্তায় বলা হয়, ৮ জানুয়ারি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের অনুরোধে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন বিউটেনিস। এরশাদ অচলাবস্থা নিরসনে সামরিক বাহিনী সমর্থিত একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু রাষ্ট্রদূত জানান, তাঁর দেশ সেনাবাহিনীর সংবিধানবহির্ভূত ভূমিকার বিরোধী।

৩০ মে বিউটেনিসের পাঠানোর তারবার্তায় বলা হয়, খালেদা জিয়া তাঁর পুত্রদ্বয় তারেক ও কোকোকে সাহায্য করার জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন।

উইকিলিকসের তারবার্তা থেকে আরও জানা যায়, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পর দুই দলেরই কতিপয় প্রভাবশালী নেতা সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করেন। কিংস পার্টি গঠনেরও উদ্যোগে শামিল হন কেউ কেউ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা কীভাবে নেবেন, জানি না। তিনি ১/১১-এর আগে ও পরের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে কড়া মন্তব্যই করেছেন। কূটনীতির ভাষায় অপছন্দের কথা যতটা কঠোর বলা
যায়, তা বলেছেন। এরপর ১২ বছর চলে গেছে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকেরা নিজেদের একটুও বদলাতে পেরেছেন কি?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]