বিএনপির 'সহায়ক সরকারের' লন্ডনযাত্রা

লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন খালেদা জিয়া
লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন খালেদা জিয়া

রাজনীতিতে একসময় বিপ্লব কথাটির বেশ চল ছিল। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে বিপ্লব হিসেবেই নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা জাসদ একাত্তরের অসমাপ্ত বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করতে গণবাহিনী গঠন করেছিল। কিন্তু তাদের সেই সম্পূর্ণ বিপ্লব আলোর মুখ দেখার আগেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ১৫ আগস্ট প্রতিবিপ্লব ঘটায়। এরপর ৭ নভেম্বরে কথিত সিপাহি বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলেও বিপ্লব ক্ষান্ত হয়নি। তখন সবকিছুতে বিপ্লবের লেফাফা দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। কৃষিবিপ্লব। শিক্ষাবিপ্লব। মৎস্যবিপ্লব ইত্যাদি। যঁারা প্রকৃত বিপ্লবকে ভয় পেতেন, তঁারাই বিপ্লব শব্দটি যথেচ্ছ ব্যবহার করতেন। চরম বামেরা শ্রেণিশত্রু খতমের মাধ্যমে নকশাল বাড়ি কায়দায় বিপ্লব করতে গিয়ে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে গেলেন। আর চরম ডানেরা যে এ দেশে তালেবান বিপ্লব করার খোয়াব দেখছিলেন, বর্তমান জঙ্গি উত্থান সম্ভবত তারই ধারাবাহিকতা।

সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে বিপ্লবের বদলে সংস্কার শব্দটি খুব চালু হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের নানা ফর্মুলা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে বিপ্লবের মতো সংস্কার শব্দটিও আমাদের রাজনীতির অভিধান থেকে প্রায় লুপ্ত।

বিপ্লব ও সংস্কারের স্থলে নতুন শব্দ যোগ হয়েছে রোডম্যাপ বা পথনকশা। আগামী দুই বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর, বিশ বছর, পঞ্চাশ বছর কোন দল কী কাজ করবে, দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে তার পথনকশা দিচ্ছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের দিশা তাতে নেই। থাকলে এত উন্নয়নের পরও  টিকাদান কর্মসূচি থেকে সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাপাড়াসহ আরও অনেক এলাকা বাদ পড়ত না। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ২৯ শতাংশ নিরক্ষর (সরকারি হিসাবে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে আরও অনেক কম) থাকত না।

২.

দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ সাড়ে তিন বছর পার না হতেই একাদশ সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে সাত দফা পথনকশা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। আর ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক দলগুলো তো প্রতিদিনই নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীকে নসিহত করে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক আগেই ২০২১ ও ২০৪১ সাল পর্যন্ত দুটি পথনকশা ঘোষণা করেছে। মাস কয়েক আগে বিএনপি ঘোষণা করল ভিশন ২০৩০। এদিকে জোটের ভাঙা–গড়া নিয়েও চলছে নানা তৎপরতা। একদা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নাজমুল হুদা এখন নৌকায় চড়ে নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হতে চাইছেন। আর পতিত স্বৈরাচার এরশাদ নিজের গুরুত্ব বাড়াতে ৫৮টি নামসর্বস্ব দল নিয়ে গঠন করেছেন ‘মহাফ্রন্ট।’ দুই বড় জোটের বাইরে থাকা বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোও নড়েচড়ে বসেছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, সেটি এখন আর বড় প্রশ্ন নয়। বিএনপির নেতারা বক্তৃতা–বিবৃতিতে যত গরম কথাই বলুন না কেন, তাঁরা নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। অনেক নেতা ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, এবার তাঁরা ২০১৪ সালের মতো ভুল করবেন না। ক্ষমতাসীন দল না চাইলেও নির্বাচন করবেন। প্রয়োজনে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে যাবেন। আওয়ামী লীগও বিএনপির কথা মাথায় রেখে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে, প্রার্থী তালিকা নবায়ন করছে। একসময় নির্বাচনী স্লোগান ছিল, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’ ২০১৪ সালে মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারেনি। তাই এবার স্লোগান হওয়া উচিত ‘ভোট দিতে পারি এমন নির্বাচন চাই।’

৩.

বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁদের দল নিয়ে যতটা না ভাবেন, তার চেয়ে বেশি ভাবছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সরকারের মন্ত্রীরা। আওয়ামী লীগের এমন কোনো সভা-সমাবেশ হয় না, যেখানে বিএনপিকে গাল দেওয়া হয় না। এটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নেতারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন, জনগণ এটি কীভাবে নিচ্ছে? অনেকে বলেন, সরকার একতরফা নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, এটি ভারি অন্যায়। কথাটি অংশত ঠিক, অংশত বেঠিক। ঠিক এ জন্য যে বিএনপির নেতারা সভা-সমাবেশ ডেকে ভোট চাইতে পারেন না। আর বেঠিক এ জন্য যে বিএনপির নেতারা সভা-সমাবেশ করে যে প্রচার পেতেন, আওয়ামী লীগের নেতারা তার চেয়ে বেশি প্রচার দিচ্ছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গালাগালের অর্থ হলো, জনগণের কাছে নিজেদের কথা বলার কিছু নেই। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে খুন-সন্ত্রাস-গুম করলেও সেসব ১০ বছর আগের ঘটনা। ভোটাররা এখনকার আমলনামার হিসাব নিতে চাইবে।

 আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরবেন কি না, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘গত শনিবার থেকে ফেসবুকে দেখেছি, টুইটারে দেখছি তাঁর (বিষয়ে) স্ট্যাটাস। এত বেশি সময়ের জন্য একটি বড় দলের চেয়ারপারসন বিদেশে যাচ্ছেন, এখন জনশ্রুতি হচ্ছে, তিনি কি মামলার ভয়ে পালিয়ে গেলেন? তিনি কি মামলার ভয়ে ফিরে আসবেন না? মামলায় ১৫০ বার আদালতে সময় চাওয়ার পর এই সন্দেহটা ঘনীভূত হচ্ছে, জনগণের মধ্যে এই গুঞ্জনটা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে।’ (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০১৭)

জনশ্রুতি নিয়ে একজন দায়িত্বশীল নেতার এ ধরনের মন্তব্য মানায় না। রাজনৈতিক অঙ্গনে তো এ রকম জনশ্রুতিও আছে যে আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আর খালেদা জিয়া বিদেশে থাকলেই সেটি সম্ভব। বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা এত বিচলিত না হয়ে নিজের ঘর সামলাক। ছাত্রলীগের হানাহানি বন্ধ করুক।

৪.

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপি আটঘাট বেঁধেই এবার নির্বাচনী মাঠে নামছে। তারা যে সারা দেশে ১ কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে, তারও উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ মুহূর্তে বিএনপি তিন কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি। ডিসেম্বরে তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনের পথনকশা চূড়ান্ত করবে। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলেছেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের একাধিক রূপরেখা তাঁরা প্রস্তুত করে রেখেছেন। সরকারের মনোভাব দেখেই এটি প্রকাশ করতে চায়। বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, তারেক রহমান লন্ডন থেকেই নিয়মিত জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, কথা বলেন। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করার আগে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন না তা কী করে হয়? স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য গণমাধ্যমে বলেছেন, দলের চেয়ারপারসন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলেও দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হবে।

বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা আমাকে বলেছেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তাঁরা সহায়ক সরকারের যে রূপরেখা দিচ্ছেন, তাতে একাধিক বিকল্প থাকবে। অন্য কোনো দল এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব দিলে সেটি গ্রহণ করতে তাঁদের আপত্তি নেই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আশা করছেন, সরকার আলোচনায় বসলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে।

বিএনপির সামনে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার বিচার। দলের একাংশ মনে করে, রায়ে খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে বিএনপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অপরাংশের ধারণা, নিম্ন আদালতে শাস্তি হলেও আপিল করার সুযোগ থাকবে এবং তাঁর নির্বাচন করতে কোনো বাধা থাকবে না। এ প্রসঙ্গে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেনের মামলার উদাহরণও দিয়েছেন কেউ কেউ। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রুমিন ফারহানা ও হুমায়ুন কবির এখন লন্ডনে আছেন বাংলাদেশবিষয়ক একটি সংলাপে অংশ নিতে। এ ছাড়া আবদুল আউয়াল মিন্টু ও তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়ালও লন্ডনে গিয়েছেন। এসবের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নেই সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। খালেদা জিয়া সহায়ক সরকারের রূপরেখা ও ভিশন ২০৩০ তৈরি করতে যে বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছেন, তার সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বিএনপির নেতাদের মতে, কেবল সহায়ক সরকারের রূপরেখা নয়, নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও তারেকের সঙ্গে আলোচনা হবে।

৫.

এসব সত্ত্বেও বিএনপির নেতৃত্বে অস্থিরতা চলছে। দলের কোনো নেতা হয়তো কোনো সমাবেশে বললেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে। অন্য সমাবেশে আরেক নেতা বলবেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। নির্বাচন হতেও দেবে না। এসবই করা হচ্ছে কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখতে। ন্যূনতম দাবি আদায় না করে নির্বাচনে গেলে কর্মীদের কাছে তাঁরা কী জবাব দেবেন? ২০১৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়ারই বা কী যুক্তি ছিল?

নির্বাচন কমিশন গঠন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খালেদা জিয়া ১৩ দফা কর্মসূচি দেওয়ার সময়ই বলা হয়েছিল, শিগগিরই তঁারা নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। কিন্তু সেই রূপরেখা এখনো হাজির করা হয়নি। এর মধ্যে দলের পক্ষ থেকে বিরাট আয়োজন করে ভিশন ২০৩০ উত্থাপন করা হয়েছে।

কয়েক মাস ধরেই বিএনপির নেতারা বলে আসছিলেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের একটি রূপরেখা দেবেন। অনেকের ধারণা, সেই রূপরেখা চূড়ান্ত করতেই খালেদা জিয়া লন্ডন গেছেন। সেখানে তিনি চিকিৎসা করানোর পাশাপাশি তারেক রহমানের সঙ্গে সহায়ক সরকার ছাড়াও দেশের রাজনীতির হালহকিকত নিয়ে কথা বলবেন। যদিও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পরামর্শ করতে লন্ডন যেতে হয় না। ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে তারেক রহমান যখন একের পর একনির্দেশনা দিয়ে আসছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে নির্বাচন ঠেকানোর রাস্তাই ধরেছে। তাতে কেবল বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার বিএনপি নির্বাচনে গেলেও সবুজসংকেতটা আসতে হবে লন্ডন থেকেই।

বিএনপির ত্যাগী নেতারা নয়াপল্টনে বসে নির্বাচন ও সহায়ক সরকার নিয়ে যাই বলুন না কেন, আসল চাবিকাঠি তাঁদের কাছে নেই। বিএনপির ক্ষমতাবলয়ের একটি চেয়ারপারসনের কার্যালয়, আরেকটি লন্ডন। সেখানেই সহায়ক সরকারের রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত হবে।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।