বিকল বিএনপি, আত্মকলহে আওয়ামী লীগ

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

খুব কম করে বললেও বলতে হয়, বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতি শুধু ভুলে ভরা। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য করে আগে কিছুটা সুফল পেলেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের পটভূমিতে পরিস্থিতি যে কিছুটা বদলে গেছে, বিএনপি সেটা হিসাবে নিতে চায়নি। জোটের অন্যতম সদস্য হিসেবে জামায়াত থেকেই গেছে। এই অবস্থায় আবার জামায়াত নেতাদের ফাঁসি হলেও বিএনপি নীরব থাকার নীতি নিয়েছে, জামায়াতের হরতাল-প্রতিবাদে সমর্থন দেয়নি। ফলে তাদের জোটের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। তারা দেখেছে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সুদিনে আছে, দুর্দিনে নেই। আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একটানা হরতাল-অবরোধ, পেট্রলবোমা-ককটেলে বাসযাত্রী ও পুলিশ পুড়িয়ে হত্যা করার নৃশংসতা মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। এভাবে একসময়ের তেজি বিএনপি সক্রিয় জনসমর্থন হারিয়ে নির্জীব হয়ে পড়েছে। ওরা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আরেকটি বড় ভুল করেছিল। যদি বিএনপির দাবি অনুযায়ী ধরে নিই, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে দিতে চাচ্ছিল না, নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগ তাদের জিততে দিত না। তারপরও প্রশ্ন উঠবে, তাদের এসব যুক্তি যে ঠিক ছিল, সেটা মানুষকে বুঝতে দেওয়ার জন্যই নির্বাচন করা দরকার ছিল কি না। যদি সেদিন বিএনপি নির্বাচনে যেত, আর যদি ক্ষমতাসীন দল জোর করে তাদের হারিয়ে দিত, তাহলে দলে দলে মানুষ রাজপথে নেমে আসার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। আজ হয়তো তাদের এমন কাহিল অবস্থায় পড়তে হতো না।
অবশ্য বিএনপির নেতারা বলছেন, পুলিশি জুলুমের কারণে তাঁরা মাঠে থাকতে পারছেন না। মামলার পর মামলা, গ্রেপ্তার, ভয়ভীতি তো নির্বিচারে চলছে।
বিরোধী পক্ষের ওপর এ রকম দমন-পীড়ন আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। সুযোগ পেলে কোনো সরকারই বিরোধী দলকে ছেড়ে কথা কয় না। ২০০১ সালে বিপুল বিজয়ের পর বিএনপি কি আওয়ামী লীগকে মাথায় তুলে রেখেছিল? রাজপথে আন্দোলন করার ‘অপরাধে’ আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে দেওয়া হয়নি? সে সময় আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ অনেক নেতা মারাত্মক আহত হয়েছেন। তাঁদের অনেককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছে।
শুধু মার তো নয়, জীবনের ওপরও হামলা এসেছিল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কীভাবে গ্রেনেড হামলায় মেরে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল, তা তো সবাই জানেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও টঙ্গীর জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই সব ভয়াবহ ঘটনার সবই হয়েছে বিএনপির আমলে। তাই বলে কি আওয়ামী লীগ বসে পড়েছিল?
গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার নীতি মানুষ সমর্থন করে না। আগেও করেনি, এখনো করে না। সরকারের জোর-জুলুম ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও গণতন্ত্র ও জনগণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াই তো একটি রাজনৈতিক দলের কাজ। কেন তারা সেটা করতে পারছে না। পুলিশের দোহাই এখানে খাটে না। আসল কথা হলো তাদের সাম্প্রতিক ভুল রাজনীতির জন্যই এখন বিএনপির মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক দলকে খেসারত দিতে হচ্ছে।
এ কথা এখন বিএনপির অনেক নেতাই বলছেন। হয়তো প্রকাশ্যে বলেন না। কিন্তু ঘনিষ্ঠ আলোচনায় তাঁরা বলেন। নাম প্রকাশে তাঁদের আপত্তি। কিন্তু তাঁরা বলেন, আর নির্বাচন বর্জন নয়। সব সময় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃত গণ-আন্দোলন করতে হবে। দিনের পর দিন হরতাল, ককটেল-পেট্রলবোমা ছাড়তে হবে। আওয়ামী লীগকে মাঠ ছেড়ে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের সুযোগ আর দেওয়া যাবে না। বিএনপির মূল নেতৃত্ব যদি নেতা-কর্মীদের মনের কথায় মনোযোগ দেন, তাহলে হয়তো অবস্থা ঘুরতে পারে।
গত বছর নির্বাচনে গেলে বিএনপিকে জিততে দেওয়া হতো কি না, সেই তর্কে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। ধরা যাক জিততে দেওয়া হতো না। কিন্তু কয়টা আসনে তারা জিততে দিত না। ১১০ না হোক, ১০০ আসনও কি পেত না? না হয় ৫০টা আসনই পেত। বিএনপির প্রেসিডেন্ট প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় রেখে এবং সামরিক শাসনের অধীনে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে তো ৩৯টি আসন পেয়েছিল। তা-ও তো নির্বাচন তারা করেছিল। সবাই জানত আওয়ামী লীগকে জেনারেল জিয়া জিততে দেবেন না। ঢাকায় তখন সিপিবির পক্ষ থেকে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক নির্বাচন করেছিলেন। তাঁর একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি বিভিন্ন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের এজেন্টদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে।
কিন্তু সেই ৩৯ আসনের আওয়ামী লীগই পরে রাজপথের আন্দোলনে বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিল। তখন জেলখানাগুলো ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীতে ঠাসা। ১৯৮০ সালের শুরুতে তারা বিভিন্ন দাবিতে অনশন আন্দোলন শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ১০-দলীয় জোট রাজপথে আন্দোলন শুরু করে। বিএনপি সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক-তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। তঁারা সেখানে গিয়ে তিন-চার সেলের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো জনসভার ভাষণের ভঙ্গিতে রাজবন্দীদের অনশন ভাঙার অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা বোধ হয় সেই প্রথম। এরপর অনশন ভাঙে। বেশ কিছু রাজবন্দী মুক্তি পান। জোরেশোরে রাজনীতি শুরু হয়।
আওয়ামী লীগের অনেক ভুলত্রুটি আছে। জোর-জুলুম চালায়। কিন্তু ওরা যে গত ৬৭ বছরের ইতিহাসে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের রাজনীতি করে চলেছে, সেখান থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে দোষ নেই। বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সর্বনাশা পথ ধরে নিজের তো বটেই, দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্যও বিপদ ডেকে এনেছে। কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এখন যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও দেশের রাজনীতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলতে পারে।
কিন্তু যেটা গেছে, গেছে। এখন তো আর সেই আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না। আজ বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু নেই। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা। এই ক্ষমতা তো তারা দেশের অগ্রগতির জন্য ব্যবহার করতে পারে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। এই আপাত শূন্যতার সুযোগ নিয়ে সরকার যদি সত্যিই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলেও তো একটা কিছু হয়। এই যে প্রতিবছর দেশে প্রায় ২০ লাখ লোক কর্মজীবনে প্রবেশের বয়সে পা রাখছে, আর তাদের মধ্যে ১৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে ও বাকি সাত লাখের হচ্ছে না, তাদের জন্য যদি একটা সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তাহলেও তো একটা কাজের কাজ হয়। কিন্তু সে রকম লক্ষণ এখনো তেমন চোখে পড়ে না।
অথচ আমাদের চোখের সামনেই তো মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড দাঁড়িয়ে গেল। ভিয়েতনাম এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশেও গণতন্ত্রের একই হাল। আছে আবার নেই। নির্বাচন হয়, আবার প্রশ্নও থাকে। পার্লামেন্ট আছে, বিরোধী দলও আছে, কিন্তু সেটা না থাকার মতোই।
এ রকম মডেল আদর্শ নয়। আমরা কেউই চাই না। কিন্তু দেশের রাজনীতির ডামাডোলে যখন এ রকম একটা অবস্থায় আমরা পড়ে গেছি, মন্দের ভালো একটা কিছু হলে দোষ কী? মানুষের ভাগ্য খুলে দেওয়াই তো আসল কথা। এখানেই সমস্যা। যখন সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই গোলাগুলি চলে, ভাগ-বাঁটোয়ারার রাজনীতি মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন তো ভরসার আর কোনো জায়গা থাকে না।
তারপরও আমরা আশা হারাব না। বিএনপি যদি দর-কষাকষি করে নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টা করে, ভালো। তবে এটা তো পরিষ্কার যে ২০১৪ সালের চেয়ে প্রতিকূল শর্তে এখন তাদের নির্বাচনে যেতে হবে। তা-ও নির্বাচনে গেলে তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি আত্মকলহের ঊর্ধ্বে না উঠতে পারে, তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো কঠিন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]