বিচারবহির্ভূত হত্যার লাতিন আমেরিকান সিনড্রোম

আর্জেন্টিনার সাবেক সামরিক কমান্ডার হুয়ান এস্টেবান কিবুর্গ সাত বছর ধরে বার্লিনে বসবাস করছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ হুয়ানকে জার্মানি থেকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেছে আর্জেন্টিনা সরকার। বিচারপ্রক্রিয়া এড়ানোর জন্য ২০১৩ সালে জার্মানি পালিয়ে আসেন হুয়ান। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসন চলাকালে তাঁর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৫০ জনকে হত্যা বা হত্যার নির্দেশের অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় আর্জেন্টিনার সামরিক শাসনবিরোধী ৩০ হাজার মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। কাজটা করে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা শেষ দিকে আর গুলিও খরচ করতে চাইত না। একসঙ্গে অনেককে ধরে নিয়ে বিমান থেকে সাগরে ফেলে দিত। ইতিহাসে যা ‘ডেথ ফ্লাইট’ নামে পরিচিত। আর্জেন্টাইনরা এই পদ্ধতি শিখেছিল ফ্রান্সের কাছ থেকে। গত শতকে আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ঔপনিবেশিক ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর লোকেরা স্বাধীনতাকামীদের বিমানে করে নিয়ে ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিত।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য গত শতকে লাতিন আমেরিকা রীতিমতো কুখ্যাত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, ‘মাদক’ নির্মূল–জাতীয় উদ্দেশ্যে হাজার হাজার মানুষ সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ব্যাপকভাবে মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষকদের নজরে আসে গত শতকেই। উল্লেখ্য, লাতিন আমেরিকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধরন ও ধারা ফরাসিদের থেকে আপনা–আপনি চলে আসেনি; বরং এসব দেশের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল। বলা যায়, ১৯৭০-এর দশকে বিভিন্ন দেশে বিরোধী মত বা বিপ্লবীদের দমনে একটি নিয়মতান্ত্রিক হাতিয়ারে পরিণত হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম করে দেওয়ার চর্চা।

ওই সময় পৃথিবী বিভাজিত ছিল পৃথক দুই রাজনৈতিক ব্যবস্থায়। একদিকে মার্কিনসমর্থিত পুঁজিবাদী বলয়ের দেশগুলোয় সামরিক স্বৈরাচারেরা ক্ষমতায় ছিল, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপ্লব রপ্তানিতে উৎসাহিত ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসকেরা সোভিয়েত প্রভাব প্রতিরোধের নামে দমন-পীড়নের যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত কুখ্যাত ‘স্কুল অব আমেরিকাস’ এ ব্যাপারে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়। তারা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু সেনাসদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়। সেটা গত শতকের ৬০-এর দশকের কথা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চিলি, গুয়েতেমালা, এল সালভেদর, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, পেরু, উরুগুয়েসহ বিভিন্ন দেশে ‘অপারেশন কনডোর’ পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে ওই অঞ্চলে হাজারো মানুষ নিখোঁজ হয়। এই অভিযানেও মার্কিন প্রশিক্ষণ বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছিল।

বিনা বিচারে এভাবে দেশের নাগরিকদের মেরে ফেলার চর্চা লাতিন আমেরিকান সিনড্রোম হিসেবে পরিচিত। এতে শুরুতেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে পুরোপুরি কবজায় নেওয়া হয়। এত ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যাতে কোনো আন্দোলন–সংগ্রাম সংঘবদ্ধ হতে না পারে। এই সিনড্রোমের প্রয়োগ ভারতেও করা হয় নকশাল আন্দোলন ও মাওবাদীদের দমনে। ভারতের নকশালপন্থীদের তেজ এখন ইতিহাস। তবে এখনো আতঙ্কবাদী বলে মাওপন্থীদের হত্যা করছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এখানে বলা যেতে পারে, লাতিন আমেরিকার বিপ্লবীরা বা ভারতের নকশালরা সরকারের বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন যাঁরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সশস্ত্র ছিলেন না।

বর্তমান শতকে লাতিন আমেরিকান সিনড্রোমে কিছুটা পরিবর্তন আসে। গত শতকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে নাগরিকদের মেরে ফেলা হতো। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। এখন মাদক নির্মূলসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনের কথা বলে সাধারণ নাগরিকদেরও বিনা বিচারে মেরে ফেলা হচ্ছে। মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলাতে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়। ফিলিপাইনেও একই পদ্ধতিতে মাদক নির্মূলের চেষ্টা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। কিন্তু এতে কি মাদকের ব্যবহার কমে আসে? মনে হয় না। শত শত মাদক ব্যবসায়ী হত্যার পরও ইউরোপে কলম্বিয়ার মারিজুয়ানার কদর ও চাহিদা দুটোই বেশি।

সম্প্রতি মেজর (অব.) রাশেদ সিনহার হত্যাকাণ্ড স্পষ্টতই লাতিন আমেরিকান সিনড্রোমের বহিঃপ্রকাশ। লাতিন আমেরিকাতেও বন্দুকযুদ্ধের গল্প শোনানো হতো। এই যুদ্ধে একচেটিয়াভাবে কেবল সন্ত্রাসীরাই নিহত হয়। কক্সবাজারেও তা–ই হয়েছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, রাশেদ সিনহা গুলি করলেও পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকতের গায়ে লাগেনি। বরং লিয়াকতের চারটি গুলিই রাশেদ সিনহাকে আঘাত করে এবং তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়ায় তাঁদের অপরাধ সাব্যস্ত হবে। আমাদের তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ওসি প্রদীপের দায়িত্ব পালনকালে টেকনাফে ১৬১টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ২০০ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এরপরও তিনি পুলিশের সর্বোচ্চ পিপিএম পদক পেয়েছেন। এর আগে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁর পদকপ্রাপ্তিতে বাধা হয়নি।

লাতিন আমেরিকাতেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নানাভাবে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও পদবি প্রদান করা হতো। অনেকটা যেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পুরস্কার। লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা বলে, এসব ক্ষেত্রে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী একাকার হয়ে যায়। এরা এতটাই বেপরোয়া ও ভয়ংকর হয়ে যায় যে শেষ পর্যন্ত কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয় না। সবারই কখনো না কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। আইনের যতই ফাঁকফোকর থাক না কেন, কেউ পার পেয়ে যায়নি।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনাই প্রথম সামরিক জান্তার বিচার শুরু করে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত অন্ধকার যুগে বামপন্থী কর্মী, বিরোধী মত ও সাধারণ নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা, নির্যাতন ও গুম করার অভিযোগে অনেককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আদালত সামরিক কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে। সামরিক জান্তা জেনারেল হোর্হে ভিদালেকে আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তবে পরবর্তী দুই প্রেসিডেন্ট সবার সাজা বাতিল করেন এবং সব সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেন। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট নেস্টর ক্রিসনার আর্জেন্টিনার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পরিবর্তন করে নতুন বিচারক নিয়োগ দেন। ২০০৫ সালে সাজা মওকুফ বাতিল করেন আদালত। ২০০৭ সালে পুনরায় বিচার শুরু আদেশ দেন বিচারকেরা। ২০১২ সালে ভিদালেকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতার সন্তান অপহরণের দায়ে ৫০ বছরের জেল প্রদান করে। ২০১২ সালে জেলে মারা যান ভিদালে।

এ ছাড়া চিলির জেনারেল আগুস্তো পিনোশে, পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি, গুয়াতেমালার সাবেক প্রেসিডেন্ট এফরেইন রিউস মনট্ট আদালতে বিচারের মুখোমুখি হন। বিচার শেষ হওয়ার আগেই পিনোশে মৃত্যুবরণ করেন। প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরির ২৫ বছর জেল হয়। আর প্রেসিডেন্ট এফরেইন রিউসকে ৮০ বছরের জেল দেন আদালত। উভয়ের বিরুদ্ধেই বিচারবহির্ভূতভাবে নিরস্ত্র নাগরিক হত্যার অভিযোগ আনা হয়। যত দেরিই হোক, বিচারের কাঠগড়ায় সবাইকেই কৃতকর্মের হিসাব নিয়ে জবাবদিহি করতে হয়। শাসকের ক্ষমতা চিরস্থায়ী না; বরং বিচারের দাবিটাই চিরস্থায়ী।

ড. মারফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।