বিজয়ের ৫০ বছর পরের বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বিনা উসকানিতে প্রথমে বিভিন্ন ব্যারাকে সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর ঘুমন্ত বাঙালি সৈনিক তারপর সারা দেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও গণহত্যার মাধ্যমে যে যুদ্ধের সূচনা, তা মোকাবিলায় আক্রান্ত বাঙালি তাৎক্ষণিক প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে এবং মধ্য এপ্রিল ১৯৭১ সালের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি আদল ও কাঠামো গঠিত হয় এবং প্রতিরোধযুদ্ধ রূপান্তরিত হয় সর্বাত্মক জনযুদ্ধে। সৈন্যবল, অস্ত্রবল, প্রশিক্ষণ সব অর্থেই এটি ছিল একটি অসম যুদ্ধ। কিন্তু ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার বিচারে এ যুদ্ধ ছিল ঘোরতর অন্যায়-অবিচার ও চূড়ান্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির এক ন্যায়যুদ্ধ।

১৯৭১ সালের ২৫ থেকে জেনারেল নিয়াজির এক লাখ পাকিস্তানি সেনাসদস্য কিছু বাঙালি দালালদের নিয়ে যে তাণ্ডব এ দেশে চালায়, তাতে এ দেশের প্রতিটি মানুষ জীবন-মৃত্যুর শঙ্কা নিয়ে প্রতিটি দিন, ক্ষণ ও মুহূর্ত ‘মুক্তি’র অপেক্ষায় প্রহর গুনত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেই দিনটি এল। তখন সারা দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা আনন্দে-উল্লাসে ফেটে পড়ে, অভ্যুদয় ঘটে বিশ্বের বুকে বাঙালির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র—বাংলাদেশ-এর। এ নতুন দেশের, যাত্রা ছিল নানাভাবে কণ্টকাকুল ও বিপৎসংকুল। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। ভৌত-অবকাঠামো, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-যানবাহন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, প্রায় সবকিছুই বিনষ্ট—বিধ্বস্ত। প্রশাসন অসংগঠিত ও অনুপস্থিত। বৈদেশিক মুদ্রার শূন্য ভান্ডার ও ভারসাম্যহীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জ। বিশ্বমন্দা ও নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বন্যা, খাদ্যাভাব, সামাজিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি।

স্বাধীনতাযুদ্ধে একসঙ্গে যাঁরা যুদ্ধ করলেন, তাঁদের মধ্যে ঘোরতর বিভক্তি। চরমতম রাজনৈতিক অস্থিরতা, রক্তারক্তি, গুম ও খুন। কলকারখানায় লুটপাট ও আগুন। মুনাফাখোর, মজুতদার ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য এবং ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অবিশ্বাস্য অগ্নিমূল্য। অবশেষে সপরিবারে জাতির পিতার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। হতভম্ব জাতি। স্বাধীনতার প্রথম ২-৩টি বছর একটি দুর্বিষহ দুঃসময়। যার সঠিক ও বাস্তব মূল্যায়ন কখনো নির্মোহভাবে হয়নি।

আজ বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই পেছন ফিরে তাকালে আমাদের স্বস্তির অনেক কারণ পাওয়া যায়। অন্তত এ ৫০ বছরে আমাদের অর্জন খুব একটা কম নয়। হয়তো অর্জন আরও বেশি হতে পারত। তবে যা হয়েছে তা খুব সামান্যও নয়, এককথায় অসামান্য। এখন বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আমাদের আরও অনেক বিষয়ে আরও গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
১৯৭০ থেকে ২০২০, বাংলাদেশের এ ৫০ বছরকে নানা সূচকে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিশ্লেষণ করতে হলে সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক অর্থনীতির সব তথ্যের একটি তুলনামূলক সমাবেশ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এখানে হয়তো সার্বিক বিশ্লেষণের সব তথ্য নেই। বর্তমানে উদাহরণ হিসেবে নানা জটিল মাপকাঠি ব্যবহার না করেও শুধু চারটি তুলনামূলক তথ্য ব্যবহার করা হলো। যথা জিডিপি, মাথাপিছু আয়, জাতীয় বাজেট ও গড়পড়তা আয়ুর একটি তুলনামূলক আলোচনা। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শুধু ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ২৭৫ মিলিয়ন ডলার। ৪৯ বছরে যা বৃদ্ধি প্রায় ৩০ গুণ। ১৯৭০-এ মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০১৮-২০১৯-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৯০৯ ডলার এবং ২০২০-এ তা ২০৬৪-এ উন্নীত হয়। তাহলে ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ।
১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি, ২০১৮-২০১৯-এ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি, ২০১৯-২০২০-এ ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি এবং ২০২০-২০২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২২ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৮-২০১৯ সালে হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি, যা ৩৪৫ গুণ বেশি। এসব কিছুর প্রতিফলন দেখা যায় বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ সড়কের ঘনত্ব, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের ৫০ বছরের অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক। যেমন সার্বিক সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু, ইপিআই, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতির উল্লেখ করা যেতে পারে।

সুশাসন না থাকা সত্ত্বেও যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু উচ্চ প্রবৃদ্ধি সুশাসনের বিকল্প নয়। প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। এ যোগসূত্র দুটোকেই বেগবান ও টেকসই করবে, ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রয়োজন হবে।

৫০ বছরের পরিবর্তনকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দর্পণে দেখারও সুযোগ আছে। তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের বর্তমান অপূর্ণতার কিছু বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে আমাদের যে উন্নয়ন, তার মধ্যে ‘সুশাসন’-এর অভাব প্রকট। সুশাসন না থাকা সত্ত্বেও যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু উচ্চ প্রবৃদ্ধি সুশাসনের বিকল্প নয়। প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। এ যোগসূত্র দুটোকেই বেগবান ও টেকসই করবে, ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রয়োজন হবে।
ফ্রিডম হাউস নামক যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থা প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অধিকার (১০টি প্রধান চলক) ও সিভিল রাইট (১৫টি প্রধান চলক) নিয়ে দেশ ও অঞ্চল ভিত্তিতে ১০০ নম্বরের একটি কমপোজিট সূচকের স্কেলের মাধ্যমে গণতন্ত্রের একটি পরিমাপক তৈরি করে থাকে। ২০১৯-এ ২১২টি দেশ ও অঞ্চলের ওপর যে জরিপ পরিচালিত হয়, তাকে একটি স্কেলের তিনটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি দেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। এ তিনটি ভাগ হচ্ছে, ১. মুক্ত, ২. আংশিক মুক্ত, ৩. মুক্ত নয় এ রকম দেশ। বাংলাদেশ ১০০ নম্বরের মধ্যে ৩৯ নম্বর পেয়ে ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের কাতারভুক্ত রয়েছে।

৬৫ নম্বরের কম পাওয়া মানে ‘আংশিক মুক্ত’ এবং ৩০-এর কম হলে ‘মুক্ত নয়’ দেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৯ সালের বিশ্লেষণে বিশ্বব্যাপী ২১২ দেশের মধ্যে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ, ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ২৫ দশমিক ১ শতাংশ দেশ যথাক্রমে মুক্ত, আংশিক মুক্ত ও মুক্ত নয় দেশ—তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে ভারত ৭১, ভুটান ৫৮, নেপাল ৫৬, শ্রীলঙ্কা ৫৫, বাংলাদেশ ৩৯, পাকিস্তান ৩৮ ও মিয়ানমার ৩০ স্কোর পেয়েছে। এখানে ভারত ছাড়া সবাই-ই আংশিক মুক্ত দেশের তালিকাভুক্ত। ভারতের কাশ্মীরকে পৃথকভাবে ‘মুক্ত নয়’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় ১০০ স্কোর করে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশ সর্বোচ্চ স্থানে এবং সৌদি আরবের (স্কোর-৭) মতো কতিপয় দেশ সর্বনিম্ন স্থানে রয়েছে। ‘ফ্রিডম হাউস প্রতিবেদন ২০২০ ’-এ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে এক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী ৬৭টি দেশে গণতন্ত্রের সূচক নিম্নগামী এবং বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিষয়ে রয়েছে বিশেষ উদ্বেগ।
ফ্রিডম হাউস ইনডেক্সের সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ দুটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সূচকের উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমটি হতে পারে ইউএনডিপি ও মেহাম্মদ বিন রশিদ আর-মাকতুম ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রণীত ‘বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক-২০২০’ এবং দ্বিতীয়টি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০২০ ’। জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১১২। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান সবার শেষে। জ্ঞান সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে আমাদের প্রাপ্তি ৩৫ দশমিক ৯, পাকিস্তানের সমান। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ যথা ভারত ৭১ তম (৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ), শ্রীলঙ্কা ৮৭ তম (৪২ দশমিক ১ শতাংশ), ভুটান (৪০ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং নেপাল (৩৬ দশমিক ২ শতাংশ)।

পদ্মা ব্রিজ, রূপপুর পারমাণবিক প্ল্যান্ট, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়ালসেতু প্রভৃতি বড় বড় কাঠামোর কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বজায় থাকলেও শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান সম্মানজনক বলা যায় না।

একইভাবে টিআই প্রণীত দুর্নীতির ধারণা সূচকে আমরা গত ২০ বছরের তুলনায় ভালো করেছি বলা যায়। একসময় দুর্নীতিগ্রস্ততায় পরপর চারবার ১ নম্বরে (২০০১-২০০৪) থাকার পর যেহেতু দেশের সংখ্যা বেড়েছে, তাই স্কোরের বড় উন্নয়ন না করেও আমাদের অবস্থান ওপরে উঠে আসে। ২০২০-এর প্রতিবেদনে ১৮০ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৪ তম। তবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে আমরা শুধু আফগানিস্তানের ওপরে আছি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সর্বসাম্প্রতিক কালের ‘গ্লোবাল কমপিটিভনেস ইনডেক্স’ ও আমাদের অবস্থানের অবনতি ঘটেছে, ১৪১টি দেশের মধ্যে ১০৫-এ নেমে এসেছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার পর আমাদের অবস্থান। পদ্মা ব্রিজ, রূপপুর পারমাণবিক প্ল্যান্ট, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়ালসেতু প্রভৃতি বড় বড় কাঠামোর কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বজায় থাকলেও শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান সম্মানজনক বলা যায় না।
আগামী বছর (২০২১) বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ বছর থেকে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন ও গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা শুরু হোক, এটি সবার আন্তরিক আকুতি।

ড. তোফায়েল আহমেদ লোক প্রশাসনের অধ্যাপক এবং শাসন ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।

tofail 101 @gmail. com