বিদায় মানবতার বন্ধু সাহসী রবার্ট ফিস্ক

সাংবাদিকতার কঠিন সময়ে রবার্ট ফিস্ক ভয়ডরহীন সাংবাদিকতার উদাহরণ। ২ নভেম্বর ফিস্ক প্রয়াত হন
রয়টার্স

সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের জন্য কোনো জুতসই শব্দ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিধায় বা বিশেষণে ফিস্ককে সীমাবদ্ধ বা আটকে রাখা যাচ্ছে না। ফিস্ক নিজেই এক ইতিহাস। অসম ও অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা করে ফিস্ক ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। যুদ্ধবাজ ও আধিপত্যবাদীদের মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর অস্ত্র ছিল কলম। দখলবাদী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের খেলায় যখন অধিকাংশ গণমাধ্যমই পশ্চিমাদের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করছে, তখন তিনিই ক্ষুরধার প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন।

ফিস্ক শক্তিশালী এক হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। অনেকেই তখন সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে বুঁদ আছি। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যকে মেনে নিয়ে সাংবাদিকতা করছিল অনেকেই। যুগটা ছিল এমবেডেড সাংবাদিকতার রমরমা অবস্থার। মূলধারার বেশির ভাগ দাপুটে গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে সাংবাদিকতা করছে। মার্কিন সেনার ক্যামোফ্লেজ পরিধান করে ইরাকে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মজুত নিয়ে নানা গল্প কাহিনি প্রকাশ করছে, ঠিক সেই সময় অনেকটা প্রকৃত সাংবাদিকতার স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন রবার্ট ফিস্ক।

লেবাননের গৃহযুদ্ধের ওপর প্রতিবেদন করতে ১৯৭৬ সালে বৈরুতে এসেছিলেন। এরপরই তিনি স্থায়ীভাবে বৈরুতে বসবাস করা শুরু করেন। আরবি ভাষাটাও শিখে নেন এর মধ্যে। অনর্গল আরবি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এটা তাঁকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল। যে কারণে তিনি খুব দ্রুতই বিভিন্ন গোপন তথ্য পেয়ে যেতেন অন্যান্য পশ্চিমা সাংবাদিকের আগে আগেই। আফগানিস্তান থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁর যোগাযোগ ধারণার চেয়েও শক্তিশালী ছিল। ফিস্ক দুবার আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার পর প্রথমবার, এরপর ২০০১ সালে ন্যাটো আফগানিস্তানে হামলা শুরু করার পরও তিনি ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।

পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তিনি আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন। ওই সময় তিনি আফগান উদ্বাস্তুদের হামলার মুখে পড়েন। ওই হামলা নিয়ে তিনি পরে লিখেছিলেন, ‘আফগানদের উত্তেজিত করার কাজটি আমরা আগেই করে রেখেছিলাম বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানকে দখল ও অস্ত্রে সজ্জিত করে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা তাদের অস্ত্র দিয়েছি এবং তাদের গৃহযুদ্ধ নিয়ে হাসি–তামাশা করেছি। আবার সভ্যতার লড়াই বলে তাদের ওপর আরেক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করেছি। এসব হামলা জায়েজ করার জন্য ‘কোলেটারাল ডেমেজ’ বলে বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছি।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ভেতরকার তথ্য ফিস্কের লেখনীতে উঠে এসেছে। তিনি সম্ভবত প্রথম ও একমাত্র সাংবাদিক, যিনি লিখেছিলেন, সিরিয়ার জঙ্গি সংগঠন আইএসের যোদ্ধারা আহত হওয়ার পর ইসরায়েলের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছে। তুরস্কের সীমান্ত দিয়ে দলে দলে জঙ্গিদের সিরিয়ায় প্রবেশ বা জঙ্গিদের সিরিয়ার তেল বিক্রির তথ্য আমরা তার প্রতিবেদনগুলোতেই পাই।

চলমান সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের স্বাধীন ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ করে ফিস্ক পশ্চিমা সরকারগুলোর বয়ানের পাল্টা বয়ান তৈরি করেছেন। এ কারণে ফিস্ক কিন্তু পশ্চিমা সমাজে যথেষ্ট বিতর্কিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তখনকার সরকার যখন মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে ইরাক হামলার আয়োজন করছে, তখন তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। ওই বৈঠক নিয়ে তিনি লেখেন, তৎকালীন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট কলিন পাওয়েল কীভাবে চুমু ও আলিঙ্গন করে সবাইকে এক অন্যায় যুদ্ধের পক্ষে রাজি করিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র এভাবেই জেনারেল পাওয়েলের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে যান বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।

তিনিই প্রথম কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে একজন, যাঁরা লেবাননের সাবরা ও শাতিলায় গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। ১৯৮২ সালে সিরিয়া সরকার কর্তৃক হামা শহরে ওপর নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন তিনি। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে তিনি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান দখল, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, কসোভোর যুদ্ধ, ন্যাটোর আফগান হামলা, ইরাক হামলা, সিরিয়ার চলমান যুদ্ধের প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। যুদ্ধ ও আরবের রাজনীতি নিয়ে বই লিখেছেন একাধিক।

যুদ্ধ–সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি একাধিকবার ঝুঁকির মধ্যেও পড়েছিলেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের শুরুতে শাত ইল আরব নদীর অববাহিকায় অবস্থান করার সময় ইরাকের ভারী গোলা বর্ষণের আওয়াজে স্থায়ীভাবে তাঁর শ্রবণশক্তি আংশিক নষ্ট হয়ে যায়। নানাবিধ ঝুঁকি ও সমালোচনার মধ্যেও তিনি লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। মৃত্যু পর্যন্ত ফিস্ক নিয়মিত ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

ফিস্ক মনে করতেন, প্রশ্ন করাই সাংবাদিকের প্রথম ও প্রধান কাজ। অন্যের বাতলে দেওয়া পথে সাংবাদিকতা হয় না। সাংবাদিকতার নামে যা হয়, তা করার জন্য জনসংযোগ বিভাগ আছে। বর্তমানে জনসংযোগ বিভাগের কাজটিই করে যাচ্ছেন অধিকাংশ গণমাধ্যমকর্মী। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদাহরণ হচ্ছেন ফিস্ক। এই ধরনের অবস্থার মধ্যেও যে প্রকৃত সাংবাদিকতা করা সম্ভব, এটা করে দেখিয়েছেন তিনি। ফিস্ক বলতেন, সাংবাদিকেরা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করবে। সব ধরনের কর্তৃপক্ষকেই প্রশ্ন করবে। বিশেষ করে যখন কোনো কর্তৃপক্ষ আমাদের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়, তখন প্রশ্ন করা একজন সাংবাদিকের অবশ্যকর্তব্য।

ইংল্যান্ডের কেন্টে জন্ম নেওয়া স্মরণীয় এই সাংবাদিক ডাবলিনে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। তিনি আয়ারল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ডাবলিনেও তিনি দ্য টাইমসের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তিনি আয়ারল্যান্ডের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি হিঙ্গিস শোকবার্তায় বলেছেন, শুধু আয়ারল্যান্ডের প্রজন্মই নয়, সারা বিশ্বের মানুষই তাঁকে মনে রাখবে সংঘাতময় অঞ্চলের প্রকৃত তথ্য তুলে আনার জন্য। একই সঙ্গে তিনি সংঘাতের পেছনের কারণগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসতেন।

সাংবাদিকতার জন্য একাধিক পুরস্কার পাওয়ায় রবার্ট ফিস্ক স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারতেন। প্রচলিত ধারার সাংবাদিকতা করতে পারতেন। এখানেই তিনি অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। তিনি যেসব এলাকায় সাংবাদিকতা করতে গিয়েছিলেন, ওই সব এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যেতেন নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকতার উদ্দেশ্যে। তিনি কখনো আপস করেননি মিথ্যার সঙ্গে। এ কারণে তিনি পশ্চিমা সমাজে সমালোচিত হলেও সারা বিশ্বেই সমাদৃত হয়েছেন। আজকের এই নিও লিবারেল কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসকদের আমলে, সাংবাদিকতার কঠিন সময়ে ফিস্ক ভয়ডরহীন সাংবাদিকতার উদাহরণ। রবার্ট ফিস্ক থেকে অন্যরা অনুপ্রেরণা নিতে পারেন, সাহস অর্জন করতে পারেন। ইতিহাস সাহসীদেরই মনে রাখে, যাঁরা একই সঙ্গে সময় ও সত্যকে ধারণ করতে পারেন। রবার্ট ফিস্ক তেমনই এক সাংবাদিক।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক