বিদেশি পর্যটক টানতেই হবে

বিদেশিরা এ দেশের মানুষ এবং তাঁদের বৈচিত্র্যময় জীবন ও জীবনযাত্রা দেখতেই বেশি আগ্রহীছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ করোনার প্রথম রোগী শনাক্তের পর প্রায় ২০০ দিনের বেশি সময় পার হয়েছে। আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে আজ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সীমিত আকারে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
এমনিতেই বাংলাদেশের ইন-বাউন্ড ট্যুরিজম অত্যন্ত সংবেদনশীল অবস্থা পার করছে। ২০১৩-২০১৪ সালে বিরোধী দলের হরতাল ও জ্বালাও পোড়াওয়ের কারণে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে গুলশানের হোলি আর্টিজানের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা টিম টিম করে জ্বলতে থাকা পর্যটনের বুকে শেষ পেরেক বিদ্ধ করে। এরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন ট্যুরিস্ট জেনারেটিং কান্ট্রিজ অথবা সোর্স মার্কেটসমূহ বাংলাদেশে রেড অ্যালার্ট জারি করে। অর্থাৎ বাংলাদেশে তাঁদের দেশ থেকে পর্যটক পাঠানো নিষিদ্ধ ঘোষণা। একে একে সব উন্নত দেশগুলো, যেখান থেকে মূলত পর্যটকেরা বাংলাদেশে আসেন, যেমন ব্রিটেন, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশগুলো পর্যটক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এর ভয়াবহতা বেশ কয়েক বছর ধরে চলে। এরপর ২০১৮ সালে আরও একটি দুর্ঘটনা আমাদের ইন-বাউন্ড পর্যটনকে বাধাগ্রস্ত করে। আর তা হলো নেপালে ইউএস–বাংলার বিমান দুর্ঘটনা। যদিও এটি নেপালের কাঠমান্ডুতে ঘটে কিন্তু যেহেতু বিমান সংস্থাটি বাংলাদেশের, সেহেতু এর রেশ আমাদের ওপরও এসে পড়ে। আর ২০১৯ সালের নভেম্বরে আসা কোভিড-১৯ বা করোনার ভয়াবহতা তো সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যায়। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় পর্যটনশিল্প। আর এর ফলে আমাদের মতো ক্ষুদ্র শিল্পের সংস্থাগুলোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

জানুয়ারি থেকে শুরু করে প্রায় ৮-৯ মাস বন্ধ থাকার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই হয় বন্ধ নচেৎ কর্মী ছাঁটাই হয়ে গেছে। অনেকেই আবার ই-কমার্সভিত্তিক নতুন নতুন পেশার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ২০-৩০ বছর একই পেশায় থাকার পর পেশা বদলের এই চেষ্টা কোনোক্রমেই পর্যটনশিল্পের জন্য সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে না। কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কোনো অংশও ট্যুর অপারেটররা পায়নি। সে ইন-বাউন্ড, আউট-বাউন্ড বা ডমেস্টিক ট্যুর অপারেটর, যাই বলি না কেন। অথচ দেশের ইন-বাউন্ড ট্যুর অপারেটররা বৈদেশিক মুদ্রা আনায়নে, ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের হিস্যায় বাংলাদেশের ইন-বাউন্ড ট্যুর অপারেটরদেরও ছোট হলেও ভূমিকা রয়েছে, এটি স্বীকার করতেই হবে। অথচ কী আশ্চর্য, পর্যটনকে শিল্প এবং থ্র্যাস্ট সেক্টর ঘোষণা করার পরও দেশের ইন-বাউন্ড ট্যুর অপারেটররা কোনো ধরনের রপ্তানি প্রণোদনা পায় না। যেখানে কাঁকড়া কিংবা কুঁচে রপ্তানি করলেও সরকার ঘোষিত রপ্তানি প্রণোদনা পাওয়া যায়, সেখানে ইন-বাউন্ড ট্যুর অপারেটররা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। অথচ শিল্প ঘোষিত বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স রিবেট এবং ট্যাক্স ফ্রি গাড়ির অন্যতম দাবিদার এই সব বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পর্যটন সংস্থাসমূহ। এমনকি কখনো কোনোকালেই এই সব ইন-বাউন্ড ট্যুর অপারেটরদের সম্মানিত কিংবা সংবর্ধিত করারও কোনো নজির পরিলক্ষিত হয়নি।

এর বাইরে রয়েছে দেশের যথাযথ ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং ও প্রমোশনাল কার্যক্রম। সরকার তার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে এই সব কার্যক্রম পরিচালনা করার যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কখনো তা পর্যাপ্ত নয়। আমার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ইতিমধ্যে অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রমোশনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নতুনভাবে ওয়েবসাইট পুনর্বিন্যাস করে আরও আধুনিকভাবে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বোর্ড। যেহেতু এখন করোনাকাল চলছে তাই পৃথিবীজুড়ে ফিজিক্যাল পর্যটন মেলার জায়গায় এসেছে ভার্চ্যুয়াল পর্যটন মেলা। বিদেশি পর্যটকেরা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে বেড়ানোর কমপক্ষে এক-দুই বছর আগে থেকেই ভ্রমণ পরিকল্পনা শুরু করে দেয়। সুতরাং করোনার এই বন্ধ সময়ে মার্কেটিং ও প্রমোশনাল কার্যক্রম চালালে এর সুফল ২০১২-এর শীতকালীন সময়ে এবং ২০২২ সাল থেকে পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে। করোনার এই অবসরকালে সরকারি ও বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলো বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যটনসংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণের মাঝে পর্যটন বিষয়ে অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন করানো। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পর্যটন কর্মে সম্পৃক্ত করে তাদের অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করলে এর সুফল দেশের বিকাশমান পর্যটনশিল্পই পাবে। আরও একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে তা হচ্ছে, প্রোডাক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।

কোন বয়সের পর্যটকেরা বাংলাদেশে বেড়াতে পছন্দ করেন এবং এখানে তাঁদের দেখার ও আনন্দের পর্যটন পণ্য কোনটি, তা জানা বোধ করি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। যার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শাখা থাকা বিশেষভাবে দরকার। আমরা যাঁরা ইন-বাউন্ড ট্যুরিজম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে-ময়দানে কাজ করছি, আমাদের বিবেচনায় মিলেনিয়াল এবং জেনারেশন এক্স গ্রুপ আমাদের দেশে খুব বেশি বেড়াতে আসবে না, কারণ তাঁদের বয়সের গড় হচ্ছে ২৪ থেকে ৫৬ বছর পর্যন্ত। যাঁরা বেবি বুমারস অর্থাৎ ৫৭ থেকে ৭০-৮০ বছর পর্যন্ত যাঁদের বয়স অর্থাৎ যাঁদের পর্যটনের ভাষায় এক্সপেরিয়েন্স ট্রাভেলার অথবা সিনিয়র সিটিজেন বলা হয়ে থাকে, শুধু তাঁরাই এ মুহূর্তে বেড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেন। আমি ৯৪ বছরের এক মহিলা পর্যটককে বাংলাদেশে পেয়েছিলাম। আর একটি বিষয় হচ্ছে, এঁদের কারোরই বাংলাদেশ প্রথম বেড়ানোর স্থান নয়। অর্থাৎ এ অঞ্চলের প্রায় সব দেশ ভ্রমণ শেষে একজন সিনিয়র পর্যটক বাংলাদেশে বেড়ানোর কথা ভাবেন। আমি গত বছর একজন পর্যটককে পেয়েছিলাম, বাংলাদেশ যাঁর ১৩৪তম দেশ ছিল। ফলে তাঁদের পছন্দের বিষয়গুলোও ভিন্নতর। শুধু ট্র্যাডিশনাল ট্যুরিস্ট স্পটের চেয়ে তাঁরা মানুষ এবং তাঁদের বৈচিত্র্যময় জীবন ও জীবনযাত্রা দেখতেই বেশি আগ্রহী। গ্রামের একজন হাস্যোজ্জ্বল গৃহবধূ কিংবা খেতে কাজ করা ঘর্মাক্ত কৃষক কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই হাসিখুশি ছোট্ট শিশুটিই তাঁদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। ঝলমলে রাতের নগরী, নাইট ক্লাব-বার কিংবা ডিসকো-ওদের কাছে মূল্যহীন, যা তাঁরা সর্বত্রই দেখতে পান। কিন্তু এমন প্রাণখোলা হাসিমাখা আমার গাঁয়ের মানুষজন, যাঁরা আর্থিকভাবে দরিদ্র কিন্তু প্রাণশক্তি এবং আতিথেয়তার জগৎসেরা, এই তো আমাদের ইন-বাইন্ড ট্যুরিজমের প্রধান আকর্ষণ।
সুতরাং ইন-বাউন্ড ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে আমাদের ট্র্যাডিশনাল ভাবনার জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের আতিথেয়তাকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে এবং আমাদের দেশের যেসব শ্রেষ্ঠ অর্জন, তা সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি, আমাদের পৌষ পার্বণ, আমাদের বীরত্বগাথা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সামনে উপস্থাপন করতে হবে। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি, আমাদের পয়লা বৈশাখ, আমাদের সব ধর্মের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ—এই সব বিষয়গুলোকেই পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারলে আবারও ইন-বাউন্ড ট্যুরিজমের সুদিন আসবেই।

তৌফিক রহমান, মহাসচিব পাটা বাংলাদেশ চ্যাপটার
taufiq@journeyplus. com