বিধিনিষেধ, শ্রমজীবী মানুষ ও প্রবাসী টিকা-নায়কেরা

ঈদ শেষে রাজধানীতে ফিরতে শুরু করেছে নগরবাসী। বিধিনিষেধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছে তারা। গতকাল গাবতলী এলাকায়।
ছবি: আশরাফুল আলম

আমার বাসা মগবাজার এলাকায়। মগবাজার চৌরাস্তা থেকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সড়ক চলে গেছে তেজগাঁও শিল্প এলাকা হয়ে মহাখালী পর্যন্ত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যানবাহনহীন সড়কে শত শত নারী-পুরুষ হেঁটে যাচ্ছেন গন্তব্যে। যেন মানুষের অন্তহীন মিছিল। কারও হাতে ভারী ব্যাগ, মাথায় বাক্সপেটরা। কারও কোলে শিশুসন্তান। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এঁদের কেউ এসেছেন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে। কেউ কমলাপুর রেলস্টেশন কিংবা এর আশপাশের কোনো বাসস্টেশন থেকে। সকাল ছয়টার আগে-পরে তাঁরা ঢাকায় পৌঁছেছেন। কিন্তু স্টেশন-টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে দেখেন কঠোর বিধিনিষেধ। সড়কে দু-চারটি রিকশা ও জরুরি সার্ভিসের পরিবহন ছাড়া কিছু চলছে না। বাধ্য হয়ে বাড়িফেরত মানুষগুলো হেঁটে চলেছে।

এক বৃদ্ধা মাকে দেখলাম কিশোর সন্তানের কাঁধে ভর দিয়ে চলেছেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আরেক দম্পতি শিশুসন্তানকে নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন, যদি কোনো রিকশা পাওয়া যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে শুরু করলেন।

এ ছিল গতকাল সকালে প্রায় পুরো ঢাকা শহরের চিত্র। প্রথম আলোর অনলাইন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সকালে ঢাকার ফার্মগেট, পান্থপথ, গ্রিন রোড, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, রিংরোড, আদাবর, ধানমন্ডি এলাকায় রাস্তায় যান চলাচল ছিল না বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটি রিকশা চোখে পড়েছে। সকাল ৯টার আগে পান্থপথ, শাহবাগ, ফার্মগেট এলাকায় বেশ কিছু মানুষকে মালপত্র নিয়ে হাঁটতে দেখা গেছে। তাঁদের বেশির ভাগই ঈদ উদ্‌যাপন শেষে সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। ফার্মগেট এলাকায় সকাল আটটার দিকে আবদুল মতিন মিয়া (৪০) নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি লঞ্চে বরিশাল থেকে সদরঘাটে সকালে পৌঁছেছেন। কোনো যানবাহন না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সদরঘাট থেকে ফার্মগেটে এসেছেন। তাঁর দুই হাতে দুটি ভারী ব্যাগ।

সকাল ১০টায় অফিসে আসার পথে কারওয়ান বাজারকে অচেনা মনে হলো। যে কারওয়ান বাজার দিনে-রাতে কখনো ঘুমায় না, সারাক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়, কোলাহল, যানবাহনের ছোটাছুটি; সেই কারওয়ান বাজার একেবারে ফাঁকা। ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ নেই। পাশের সদা ব্যস্ত কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউও তখন খাঁ খাঁ করছে। টহল পুলিশ, বিজিবি ছাড়া কিছু নেই। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর ঢাকায় এ রকম দৃশ্য আর চোখে পড়েনি।

যে কারওয়ান বাজার দিনে-রাতে কখনো ঘুমায় না, সারাক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়, কোলাহল, যানবাহনের ছোটাছুটি; সেই কারওয়ান বাজার একেবারে ফাঁকা। পাশের সদা ব্যস্ত কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউও খাঁ খাঁ করছে। টহল পুলিশ, বিজিবি ছাড়া কিছু নেই। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর ঢাকায় এ রকম দৃশ্য আর চোখে পড়েনি।

শুক্রবার ভোর থেকে ১৪ দিনের বিধিনিষেধ শুরু হলো। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এই ১৪টা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে আমাদের আহ্বান থাকবে, মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসা যাবে না। যদি এটা করতে পারি ১৪ দিনের জন্য, তাহলে আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব।’ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এবারের বিধিনিষেধে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস; সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন; অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। চলবে না তৈরি পোশাক কারখানাও।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির নেতারা করোনা মোকাবিলায় বরাবর স্বাস্থ্যবিধি মানা ও কঠোর বিধিনিষেধের ওপর জোর দিয়ে আসছেন। তাঁরা একবার বিধিনিষেধ কঠোর করা, একবার শিথিল করার বিরোধিতা করছেন। তাঁদের মতে, ঈদের পর নেওয়া বিধিনিষেধ কর্মসূচি সফল না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এবারকার বিধিনিষেধের সূচনায় মনে হলো সরকার চাইলে বিধিনিষেধ সফল করা অসম্ভব নয়। সরকার যদি মানুষকে বোঝাতে পারে এ বিধিনিষেধ তাদের কল্যাণের জন্য, দেশের মঙ্গলের জন্য, তাহলে তারা মেনে চলে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তিন-চার দিন ধরে যাঁরা শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছেন, তাঁরা ঈদের পরদিনই কীভাবে ফিরবেন? আমাদের হতবাক করে দিয়ে বেশির ভাগই ফিরে এসেছেন। গতকাল কেবল ঢাকার সড়ক নয়, মহাসড়কগুলোও ছিল যানবাহনশূন্য। তারপরও মানুষ ফিরে এসেছে। পথের বিড়ম্বনা ও কষ্ট তাদের আটকাতে পারেনি।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেছিলেন, ঈদের আগে যাঁরা গ্রামে গেছেন, তাঁরা যেন বিধিনিষেধের সময় গ্রামেই থাকেন। যাঁদের অফিস-কারখানা বন্ধ, তাঁরা অনুপস্থিত থাকলে হয়তো বেতন-মজুরি কাটা যাবে না, কিন্তু যাঁরা বাসাবাড়িতে কাজ করেন, যাঁরা শহুরে ভদ্রলোকদের বাড়ি ও সম্পদ পাহারা দেন, যাঁরা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ, তাঁদের চলবে কীভাবে? রাস্তায় গণপরিবহন না থাকলেও তাঁদের আসতে হবে, এসেছেনও।

তবে ১৪ দিনের বিধিনিষেধ কার্যকর করতে হলে ঘরে থাকা বা বেকার হওয়া গরিব মানুষগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের ঘরে নগদ টাকা বা চাল-ডাল-লবণ পাঠাতে হবে। কে করবেন এ কাজ? স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি তথা মেয়র-কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সম্পৃক্ত করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও। মেয়র কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করছেন, ভালো কথা। কিন্তু গরিব মানুষগুলোকেও তো খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশে আগে থেকে প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। করোনাকালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত কোটি। তারা রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে একটু সহানুভূতি, একটু সহযোগিতা কি দাবি করতে পারে না?

২.

আমাদের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা যখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার ‘সাফল্যের কৃতিত্ব’ ও ‘ব্যর্থতার খতিয়ান’ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন বাহাস করে চলেছেন, তখন চার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কোভ্যাক্স থেকে বিনা মূল্যে টিকা পেতে।

নানা দুঃসংবাদের মধ্যেও ২০ জুলাই ডেইলি স্টার-এ সাংবাদিক গোলাম মোর্তজার প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে করোনার টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে চার প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা হলেন কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক চৌধুরী হাফিজ আহসান, নেফ্রোলজিস্ট অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমেদ সাদেক, কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক মাসুদুল হাসান ও সাবেক সিনিয়র ইউএন অফিশিয়াল মাহমুদ উস শামস চৌধুরী। তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কোভ্যাক্স থেকে আমরা উল্লেখযোগ্য টিকা পেয়েছি। আরও টিকা আছে পাইপলাইনে।

এই চার বাংলাদেশি-আমেরিকানকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন কানাডা থেকে ডা. আরিফুর রহমান, বাংলাদেশ থেকে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরসহ আরও অনেকে।

কোভ্যাক্সের আওতায় কোন দেশগুলোকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, কী পরিমাণ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী ‘ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটি’ গঠন করেছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাসুদুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বাইডেন প্রশাসনের ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটিতে ঢোকা। কাজটি খুবই কঠিন ছিল আমাদের জন্য। কমিটিতে ঢুকতে না পারলে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না। সিনেটর ক্যাথরিনের ব্যক্তিগত কার্ডিওলজিস্ট ডা. হাফিজ। ক্যাথরিনের মাধ্যমে আমরা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের শরণাপন্ন হই। কমলা হ্যারিস ও ক্যাথরিনের আন্তরিক সহযোগিতায় কমিটিতে ঢোকাতে সক্ষম হই অধ্যাপক ডা. হাফিজকে। তিনি ভ্যাকসিন পাবে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল না। ১৮১টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৮টি দেশের তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশও।’

কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ভ্যাকসিন দেওয়ার যে ১৮টি দেশের তালিকা করেছে, এবার তার মধ্যে মাত্র দুটি দেশ ভ্যাকসিন পেয়েছে। বাংলাদেশ ৩০ লাখ ডোজ আর ইউক্রেন ১০ লাখ ডোজ।

এই চার প্রবাসী বাংলাদেশি কেবল টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেই সহযোগিতা করেননি। তাঁরা বাংলাদেশে ৪০০ ভেন্টিলেটর পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটি এক হাজার ভেন্টিলেটর পেয়েছিল; যার ৪০০টি পেয়েছে বাংলাদেশ আর ৬০০টি পেয়েছে ভারত। বাংলাদেশের পাওনা ১৫০টি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। বাকি ২৫০টিও আসার পথে আছে। এর প্রতিটির দাম ১৫ হাজার ডলার হলেও বাংলাদেশ পাচ্ছে বিনা মূল্যে। শুধু পরিবহন খরচ বাবদ প্রতিটির জন্য ১০০ ডলার দিতে হবে।

এ লেখা যখন শেষ করেছি, তখনই খবর পেলাম অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশটির পার্লামেন্টে আবেদন জানিয়েছেন, সেখানে উদ্বৃত্ত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার পাঁচ কোটি টিকা যেন বাংলাদেশকে বিনা মূল্য দেওয়া হয়। পার্লামেন্ট আবেদনটি অনুমোদন করেছে। এখন ১০ হাজার লোকের সই সংগ্রহ হলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী সেটি প্রস্তাব আকারে পার্লামেন্টে উপস্থাপন করবেন। আড়াই কোটি জন–অধ্যুষিত অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচ কোটি ডোজ টিকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। এ ছাড়া ফাইজার ও মডার্নার প্রচুর টিকা দেশটি আমদানি করেছে। অস্ট্রেলীয় নাগরিকদের আমদানি করা টিকার প্রতি বেশি আগ্রহ। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা প্রতিদিন টিভিতে ফটোসেশন করেন, একবার ভেবে দেখুন দেশের মানুষের জন্য তাঁরা কী করছেন আর প্রবাসী নাগরিকেরা কী করছেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]