বিবাহবিচ্ছেদ কেন বেড়ে চলেছে


অস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্র ‘আ সেপারেশন’–এর শেষ দৃশ্যটি স্মরণ করা যাক। মা–বাবার বিচ্ছেদ মামলা পারিবারিক আদালতে গড়িয়েছে। শুনানি শেষ। দম্পতির কিশোরী কন্যাকে ডাকলেন বিচারক। বাইরে অপেক্ষমান বিচ্ছেদের রায়-প্রত্যাশী দম্পতির প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো যেন আর কাটে না। ভেতরে বিচারক কন্যাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তার কিছু বলার আছে কি না। কন্যাটির উত্তর—‘আমাকে কি বলতেই হবে?’

ছবিটির এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু দর্শকের কানে সিনেমার শেষ মুহূর্তটির শেষ সংলাপ ‘আমাকে কি বলতেই হবে?’ একটি দম আটকে দেওয়া অনুভুতির জন্ম দিতে পারে। কারণ, কিশোরীটির একটি উত্তরের পেছনে অসংখ্য উত্তর আছে। ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘জানি না’, ‘আমার কিছু আসে যায় না’, ‘তাদের সম্পর্ক তারাই বুঝবে’, ‘আমি কী করতে পারি? আমার দায় কেন হবে, ‘আমার কারণেই তাঁরা অসুস্থ সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন, এ রকম খোঁটা এবং দায় আমি নিতে যাব কেন’, ‘তাঁরা নিজেদের সম্পর্কের দেখভালেই ব্যর্থ, আমার দেখভালে সফল কীভাবে হবেন?’—এ রকম অসংখ্য সম্ভাব্য উত্তরও হতে পারে।


বিয়ে, পরিবার, সন্তানপালন ইত্যাদি বিষয়ের গবেষক ও লেখক বারবারা ড্যাফো হোয়াইটহেড ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত দ্য ডিভোর্স কালচার নামের এক বইতে লেখেন, ১৯৫০ দশকে পৃথিবীর অধিকাংশ অসুখী দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাত না সন্তানদের কারণে আর সামাজিক দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে, তবু তারা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অসুখী সম্পর্কটিই টিকিয়ে রাখত। ১৯৬০ দশকে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা বেশ বেড়ে যায়।

নারী অধিকার আন্দোলন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, বর্ণবাদমুক্তি ও সমানাধিকারের আন্দোলনের প্রভাবে পরিবারের সনাতন চরিত্র টিকে থাকতে পারছিল না। পরিবারের শিশু-কিশোরদের মঙ্গলের কথা ভেবে যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহবিচ্ছেদ আইন কঠিন করা হলো এবং বিচ্ছেদপ্রার্থীদের ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা ও ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হলো। কিন্তু আইনটি অচিরেই অকার্যকর প্রমাণিত হতে থাকল।

পিতা–মাতার বিচ্ছেদের প্রভাব সন্তানের ওপর সাময়িক। কিছুটা সময় সন্তানসন্ততি মানসিক বিষণ্নতা ও অবসাদে ভোগে। তারপর সময়ের পরিক্রমায় কষ্টগুলো কাটিয়ে ওঠে। কারণ, তারা ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে শুরু করে স্কুলের পাঠক্রমে সম্পর্ক, অধিকার-কর্তব্য, দায়িত্ব, আচরণের গণ্ডি ইত্যাদি–সংক্রান্ত শিক্ষা পায়।

১৯৬২ সালে নারীদের ওপর একটি মতামত সমীক্ষায় ৫১ ভাগ নারীই বলেন, তাঁরা শুধু সন্তানের কথা ভেবে অসুখী সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবেন না। জরিমানা দিতে হলে তা–ও দেবেন। তাঁরা রাষ্ট্রকে কর দিচ্ছেন, রাষ্ট্রও তাঁদের সন্তানদের দেখভালের কিছু কিছু দায়িত্ব নিক। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাজ্যে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের নিয়মকানুন শিথিল করা হলো।

কারণ, ব্রিটেনের পারিবারিক আদালতগুলো বুঝতে শিখল যে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রেমহীনতাকে আইন ও চুক্তির শিকলে বেঁধে প্রেমে রূপান্তর ঘটানো অসম্ভব। ১৯৭৭ সালে একই রকম সমীক্ষায় একই মতামতদানকারী নারীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ ভাগে। অর্থাৎ ৮০ ভাগ নারীই বলেন জীবন তাঁদেরও। শুধু সন্তান-চিন্তাকে অবলম্বন করে অস্বাস্থ্যকর দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবেন না। নিজেদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবেন না।

পশ্চিমে এই সব গবেষণার দারুণ ফল মিলল। জানা হলো যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবার ও সম্পর্কে ভাঙন বাড়বেই। বিবাহবিচ্ছেদও বাড়বেই। শুধু ধর্ম, নীতিকথা, আইন কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা দিয়ে এই জোয়ার ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব। কল্যাণরাষ্ট্রগুলো যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও কানাডা তো বটেই, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশও শিক্ষা, চিকিৎসা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পরপরই শিশু ও পরিবারকল্যাণ কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা শুরু করল এবং অত্যন্ত দ্রুত কাজটি করল।

অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলোতে এই বিনিয়োগের ফলাফল জানতে হলে কানাডার ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ নামক সরকারি বিভাগটির ‘পারিবারিক আইন’ শাখাটির অসামান্য গবেষণা ভান্ডারের দ্বারস্থ হতে হয়। এই গবেষণা ভান্ডারের তথ্যপুঞ্জ থেকে যুক্তরাজ্যে পরিচালিত ২০০টি গবেষণার বিষয় ছিল সন্তানের ওপর পিতা–মাতার বিচ্ছেদের প্রভাব।

গবেষণাগুলোর ফলাফল এই যে পিতা–মাতার বিচ্ছেদের প্রভাব সন্তানের ওপর সাময়িক। কিছুটা সময় সন্তানসন্ততি মানসিক বিষণ্নতা ও অবসাদে ভোগে। তারপর সময়ের পরিক্রমায় কষ্টগুলো কাটিয়ে ওঠে। কারণ, তারা ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে শুরু করে স্কুলের পাঠক্রমে সম্পর্ক, অধিকার-কর্তব্য, দায়িত্ব, আচরণের গণ্ডি ইত্যাদি–সংক্রান্ত শিক্ষা পায়। তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়।

ফলে পিতা-মাতার বিচ্ছেদ শিশু-কিশোরদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী অভিঘাত সৃষ্টি করে না। কিন্তু এখন যেমন দ্বিমত নেই, তখনো সবাই সহমত ছিলেন যে পিতা–মাতার বিচ্ছেদ সন্তানদের অবশ্যই বিপর্যয়কর। প্রাচ্যে বেশি বিপর্যয়কর। কারণ, প্রাচ্যে পরিবারকে ধর্মীয় আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধের চোখে দেখা হয়। ‘পরিবার’ যে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ভাঙন বা বিপর্যয়ও যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেই সমাজতাত্ত্বিক অভিজ্ঞানের দারুণ ঘাটতি রয়েছে বিশ্বায়নের অংশ হয়ে পড়া বাংলাদেশ সমাজেও।


বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান বিবাহবিচ্ছেদ পর্যালোচনায় পেছনে পড়ে রয়েছে। গত ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই সত্যটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রতিবেদনটির প্রতিক্রিয়ায় পাঠক মহলের একটি অংশে উদ্বেগ লক্ষ করা গেছে। স্কট কলেট্রন ও মিশেল এডামস নামের দুজন সমাজবিজ্ঞানী এই অবস্থাকে ‘কালেক্টিভ অ্যাংজাইটি’ বা ‘সামষ্টিক দুর্ভাবনা’ বলতেন। তাঁরা মনে করেন, বিবাহবিচ্ছেদ একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এটিকে বিরাট বিধ্বংসী ‘সমস্যা’ ভাবা আসলে সমাজের তৈরি করা আতঙ্ক। বিবাহবিচ্ছেদ বিষয়টিকে আলোচনা-নিষিদ্ধ ট্যাব্যু ভাবলে এমনটি হয়। তার ওপর রয়েছে লোকলজ্জা, ভয়, দ্বিধা, সন্তান ও স্বজন এবং সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা।

প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষককে উদ্ধৃত করা হয়েছে, যাঁরা বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে ‘নৈতিকতার পতন’, ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’, ‘নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ ইত্যাদি নানা রকম মূল্যবোধতাড়িত মতামত দিয়েছেন। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের পাঠক্রমে ‘সামাজিক সমস্যা’ শিরোনামের একটি অধ্যায় এই মূল্যবোধ তাড়নার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।

প্রথাগত সমাজবিজ্ঞানে মাদক, যৌতুক, কিশোর অপরাধ ইত্যাদি অনেক কিছুর পাশাপাশি ‘বিবাহবিচ্ছেদ’ও ‘সমস্যা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকে। বিষয়টি ছেলেমানুষিপূর্ণ। তার প্রকাশ দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর শ্রেণির ছাত্রদের পরীক্ষার খাতাগুলোতেও। তারাও বিবাহবিচ্ছেদের কারণ লেখে ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’, ‘বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব’ ইত্যাদি।

২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘এত দ্রুত বিচ্ছেদ’ শিরোনামে মনোবিদ্যার এক শিক্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছেন। আলোচনাটি অনেকটা দাম্পত্য সম্পর্ক ‘টিকিয়ে রাখা’র জন্য স্বামী-স্ত্রীর কী কী করণীয় অথবা করণীয় নয় সে সব বিষয়ে পরামর্শ ধরনের।‘ফ্যামিলি কাউন্সেলিং’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে, কিন্তু প্রেম-ভালোবাসাহীন, অস্বাস্থ্যকর ও গভীরতাহীন সম্পর্ক নানা রকম টোটকা প্রয়োগের মাধ্যমে জোরজবরদস্তি টিকিয়ে রাখাও যে নর-নারীর মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, সে ভাষ্যও মনোবিদ্যাতেই মেলে।

বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ জানার পদ্ধতিটিও ত্রুটিপূর্ণ। বিচ্ছেদের আবেদনপত্রে মান্ধাতা আমলের ‘বনিবনা না হওয়া’, ‘মতের অমিল’, শারীরিক নির্যাতন’, ‘যৌতুক’, ‘শারীরিক অক্ষমতা’, ‘অসুস্থতা’, ‘বিবাহবহির্ভূত অবৈধ সম্পর্ক’ ইত্যাদি গৎবাঁধা কারণ ছাপা থাকে। আবেদনকারী শুধু টিক চিহ্ন দিয়ে যান।

বিস্তারিত কারণ উল্লেখের সুযোগ থাকলেও নথিবদ্ধকারীরা আবেদনকারীদের নিরুৎসাহিত করেন। টিক চিহ্নের আড়ালে হারিয়ে যায় অসংখ্য আসল গুঢ় ও গভীর কারণ। অথচ কারণগুলো সঠিকভাবে জানার কোনো বিকল্প হতে পারে না।


প্রথম আলোর প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় দিনে ৩৯টি তালাক’। এর মূল বক্তব্য— বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। এ বছরের গত পাঁচ মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের হার ৩০ ভাগ বেশি। বিবাহবিচ্ছেদের ৭০ ভাগ আবেদনই এসেছে নারীদের পক্ষ থেকে। করোনাকালে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটছে। একই প্রতিবেদনে এ কথাও এসেছে যে আসলে করোনার আগেই অর্থাৎ ২০১৯ সালেও প্রতি মাসে গড়ে ৯২০টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে।

অর্থাৎ করোনার কারণেই যে বেড়েছে, সে রকম দাবি করার সুযোগ কম। নারীরা উদ্যোগী হয়ে বেশি তালাক দিচ্ছেন তথ্যটি কৌতুহলোদ্দীপক, তবে চমকে দেওয়ার মতো নয়। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধের বজ্র-আঁটুনি কাটাতে সাহস করে তাঁরা দুই কদম বেশি স্বপ্রণোদিত হয়েছেন বলে অনুমান করা যায়। বাস্তবতা এই যে বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশে দাম্পত্য সম্পর্কে জটিলতা বাড়বে, বিবাহবিচ্ছেদও বাড়বে।

এই বাস্তবতা অস্বীকার না করে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে উদ্ভুত সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে ভাবা উচিত। পৃথিবীর অনেক অর্ধশতক আগে থেকেই পরিবার ও শিশুকল্যাণ কর্মসূচি চালু রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই এখনো সেভাবে শুরু হয়নি। বিবাহবিচ্ছেদ ‘মহামারির মতো’ বেড়ে যাচ্ছে ভেবে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং পরিবার ও শিশু কল্যাণ কর্মসূচিকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করা দরকার।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ এবং রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি