বিরাজনীতিকরণের নির্বাচন ও বর্তমান রাজনীতি

ঢাকা সিটি নির্বাচনের ভোটাভুটি শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর অনলাইন নিউজ পোর্টালে খুঁজে দুই সিটি নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট হাসিল হয়েছে, তার ইসি প্রদত্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাইনি। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর কেন্দ্রওয়ারি ভোটের হিসাব পেতে সময় লেগেছিল বহু বহু সপ্তাহ। ইসি দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম ভাঙার পর যে হিসাব দিয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল যে শতাধিক কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল শতভাগ।

অনেক কেন্দ্রে যত ভোট পড়েছিল, তার সবকিছুই গেছে এক মার্কায়। আমার পরিচিত এক সাবেক চেয়ারম্যান এবং একই এলাকার সাবেক সাংসদ সেই মধ্যরাতের নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলেন কমবেশি কুল্লে ১ হাজার ৩০০। সেসব পুরোনো কাসুন্দি।

এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্রওয়ারি ভোট হাসিলের হিসাবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোনো গত্যন্তর নেই। সাংসদদের বাজেট থেকে এলাকাভিত্তিক থোক বরাদ্দের মতো নির্বাচনের ফলাফলও ঘোষণা করা হচ্ছিল থোক বরাদ্দের কায়দায়। ১৯টি সেন্টার থেকে মেয়র পদে প্রাপ্ত ভোট অমুক-তমুক। তারপর এক লাফে হয়তো ৪৬ কেন্দ্র। তারপরে কখনো ছোট লাফ হলে একেবারে ৭০ অথবা ৯০ কেন্দ্র। কিছু এদিক-সেদিক হতে পারে, কিন্তু ফর্মুলা ছিল থোক বরাদ্দের। কোন কাজে কত টাকা বরাদ্দ বা ব্যয় হবে, তার খুঁটিনাটি হিসাব রাখা বা হিসাব দেওয়া সাংসদের জন্য যেমন অবমাননাকর, তেমনি হয়তো ইসিও ভেবেছে প্রতি কেন্দ্রের ফলাফল আলাদা আলাদাভাবে ঘোষণা করার ঝুটঝকমারির কোনো দরকার নেই, একেবারে জয়-পরাজয় জানিয়ে দিলেই হলো।

ভোট যেভাবেই হোক না কেন, ভোট হাসিলের সংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগের ওপরে যাবে বলে মনে হয় না। অবশ্য, শেষতক ইসির মেজাজ-মর্জি কী হয়, সেটার ওপরও শতকরা হিসাব নির্ভর করতে পারে।

নিকট অতীতেও অনেক সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোট পড়েছে কমবেশি শতকরা ৬০ ভাগ। ‘ভোটারদের উপস্থিতি খুবই নৈরাশ্যজনক’—এম সাখাওয়াত হোসেনের লেখায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক বেশি ভোট হাসিলের ছোট্ট বয়ান আছে (প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। এই নৈরাশ্যজনক ভোট হাসিলের হারের পেছনে কারণ প্রধানত আড়াইটা।

২.
প্রথম কারণ হলো—বলা বাহুল্য, এটা অধমের ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, যার সঙ্গে প্রত্যেক পাঠকই দ্বিমত করতে পারেন—প্রায় সবার কাছেই জানা ছিল নির্বাচনে কে জয়ী হবেন। যেহেতু জয়ী ব্যক্তির নাম-ঠিকানা সবাই নির্বাচনের আগেই জানতেন, তাই তাঁরা কষ্টমষ্ট করে হেঁটে বা চড়া দরে রিকশায় চড়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। অবশ্য জয়ী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মজাটাই আলাদা, তাই জয়ী প্রার্থীর সমর্থকদের অনেকে গিয়েছিলেন সেই মজায় ভাগ বসাতে। কিছু লোক গিয়েছিলেন চরম আশায় বুক বেঁধে, চূড়ান্ত ফলাফলের ব্যাপারে মনে মনে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও। আর বাকি শতকরা ৭৫ ভাগ বা তারও বেশি ভোটার দিনটা বাসায় কাটিয়েছেন, সম্ভবত গড়াগড়ি করে, টেলিভিশন দেখে, আড্ডা মেরে অথবা হয়তো কিছু কাজকর্ম করে। পূজার সঙ্গে শুক্র-শনিবার, তাই অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার কিছু বন্ধুবান্ধব পাহাড়চূড়ার সাজেক ভ্রমণকেন্দ্র (রাঙামাটি) থেকে ফোন করেছিলেন। জানালেন, তখন সেখানে হাজার হাজার ভ্রমণকারী। ঢাকার ভোটাররা দলে দলে সাজেকে গিয়েছিলেন কি না, কে জানে।

দ্বিতীয় কারণটা হলো, ভোটকেন্দ্রে গলাধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা। নির্ভয়ে ও অবাধে ভোট দিতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারেও বহু বহু ভোটার ছিলেন শঙ্কিত। ঢাকায় নামানো হয়েছিল ২০ হাজারের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। আজকাল প্রায় বলা হয় যে অমুক বা তমুক উপলক্ষে ৩,৪, ৫,৬ বা ওই গোছের স্তরে স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থা—যুদ্ধবিগ্রহ এই লেগে গেল বোধ হয়। তারপর আগেই বলেছি, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। সঙ্গে ছিল ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দাপট। কেন্দ্রে কেন্দ্রে একটা বিশেষ মার্কার ডজন ডজন ‘স্বেচ্ছাসেবক’। যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থায় এত এত ‘স্বেচ্ছাসেবক’কুলের মাঝখানে গিয়ে নিরাপদে ভোট দিয়ে ফিরে আসতে পারবেন কি না, সেই শঙ্কাও ছিল স্বল্প ভোট হাসিলের অন্যতম প্রধান কারণ।

এই গেল দুটো। তাহলে পাঠক সুধাবেন আর বাকি অর্ধেক কারণটা কী। অর্ধেক কারণটা হলো, বিরোধীদের ইভিএমবিরোধী প্রচারণা। এই প্রচারণায় অনেকের ধারণা হয়েছিল যে এই ইভিএমের বদৌলতে ভোটার যেই মার্কাতেই বোতাম চাপুক না কেন, মেশিন সেই ভোট যোগ করবে একটা পূর্বনির্ধারিত মার্কায়। ইভিএম সম্পর্কে এক বিজ্ঞ অধ্যাপক হিসাব দিয়েছিলেন—যত দূর মনে পড়ে, বিশ্বের গোটা চল্লিশেক দেশে ইভিএম যন্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছিল ভোটাভুটিতে। এখন নাকি মাত্র চারটি দেশে ইভিএম ব্যবস্থা চালু আছে। তা-ও আবার ‘পেপার ট্রেইল’সহ অর্থাৎ কোন মার্কায় ভোট দেওয়া হয়েছে, তা ইভিএম মেশিন ছাপা করে রাখবে। যাতে পরে কাইজ্জা লাগলে অর্থাৎ ভোট পুনরায় গণনার দরকার হলে কাগজের প্রমাণ হাজির করা যায়। আমাদের ইভিএম কাগজ-টাগজের ধার ধারে না। বিরোধীদের বোঝা উচিত ছিল যে এই ডিজিটাল বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল’ পদ্ধতি বাতিল করার যেকোনো আন্দোলনে মেওয়া ফলবে না। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে আরও বেশি ভোটার নির্বাচন পদ্ধতিতে আস্থা হারিয়েছেন।

৩.
নির্বাচনব্যবস্থা আর রাজনীতির ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের যেটুকু বাকি ছিল, তার প্রায় পুরোটাই উবে গেছে ঢাকা সিটি নির্বাচনের ভোট হাসিলের এই অতি অল্প সংখ্যায়। আবার কে কখন পূর্ণ বিশ্বাসে ভোট দিতে যাবেন অর্থাৎ, শঙ্কামুক্ত হয়ে অবাধে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবেন আর সেই ভোট যাঁকে দিয়েছেন সেই প্রার্থীর ঝুলিতেই পড়বে এবং শেষতক হিসাবটাও হবে সঠিকভাবে—সেই ধারণা এ দেশে কখন ফিরে আসবে, কে জানে। যত বেশি নির্বাচন হচ্ছে, তত বেশি নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর নিঃসন্দেহে আস্থা কমছে। অবশ্য যাঁরা এই ব্যবস্থায় লাভবান হচ্ছেন, তাঁদের আস্থা শনৈঃ শনৈঃ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাই তো টেলিভিশন সংবাদে শুনলাম, গত শতবর্ষেও এত ভালো নির্বাচন এ দেশে হয়নি! মারহাবা!

৪.
রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল আর সব মিলিয়ে রাজনীতিতে যখন জনগণের আস্থা প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন সেই পরিস্থিতিকেই বলা হয় বিরাজনীতিকরণ। দেশে অবশ্যই রাজনৈতিক নেতারা আছেন, রাজনৈতিক দল আছে অসংখ্য এবং রাজনীতিও; কিন্তু ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। কেন যাননি তার আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। আড়াইটার জায়গায় কারণ হতে পারে অন্য ১০,২০ বা ৩০ টা। সেই কারণগুলো আরও অনেক গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্যও হতে পারে, কিন্তু তাতে ফলাফলটা তো ভিন্ন হবে না।

ঢাকা সিটির নির্বাচনে প্রতি চারজন ভোটারে শুধু একজন ভোট দিতে গেছেন। বাকি তিনজন ঘরে বসে ছিলেন। ব্যর্থ হয়েছে বিরোধীরা, তার থেকেও বেশি ব্যর্থ জয়ীরা। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গেল দেশের ও জাতির। এই ক্ষতি কোনো একধরনের—তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন—নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ভোটসহায়ক পর্ষদের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর নেই। নাহলে দেশ ও সমাজের ক্ষতির পাল্লাটা দিন দিন এত বেশি ভারী হয়ে পড়বে যে অনেক কিছুই হঠাৎ উল্টে যেতে পারে। উন্নয়নের চাকা বন্ধ হয়ে যাবে। কিছু কিছু ক্ষমতাবানের ক্ষমতা সাংঘাতিক বেড়ে যাবে আর চারদিকে বাড়বে অশান্তি, নৈরাজ্য ও অপরাধ।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক