বিলেতি ইফতার ও ঈদ

ইফতার করতে বসেছি এক নিমন্ত্রণে, পেস্তা প্লেটে নিয়ে। সামনে সৌদি খেজুর, ভারতীয় ছোলা ভাজা ও ডালের পেঁয়াজু, পাকিস্তানি রুহ আফজার শীতল শরবত, ভারতীয় চালের খিচুড়ি ও কাচ্চি, মিয়ানমারের মাছ ভাজা, ব্রিটিশ মুরগির কোরমা ও ভেড়ার কাবাব। ফল আলাদা রাখা হয়েছে। সেখানে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার কলা ও নরম শ্যারন, ইউরোপিয়ান আপেল, ন্যাক্টারিন ও প্লাম। আরও আছে ব্রিটিশ দুধের পাশে পাকিস্তানি হানি ম্যাঙ্গো। এখানে বাংলাদেশের তো কিছু নেই! হঠাৎ দেখি একজন মুড়িমাখা নিয়ে ঢুকল—বাংলাদেশের মুড়ি!
বিলেতের ঈদ-বাণিজ্যে বাংলাদেশ নেই। আমরা যা আহার করি তার জন্য নাহয় জিবের কাছে সমর্পিত হয়েছি বলে ধরে নিলাম। কিন্তু পোশাক? পাকিস্তানি পাঞ্জাবি, সালোয়ার, দুনিয়ার চুমকি লাগানো ভারতীয় লেহেঙ্গা ও শাড়ি, আর সুইস শিফন। ঈদের পাশাপাশি বিয়েশাদিতেও আমরা সিরাজ বা টিপু সুলতান। আজকাল ছেলেরা আবার তলোয়ারও রাখে। মেয়েরা হয়ে ওঠে আনারকলি ও ফাতেমা জিন্নাহ।
খেতে বসে এই ভাবনার কিনার পাই না। ঈদের সময় হলে শেষ রোজায় চান্দ্ররজনীতে এখানে একসঙ্গে প্রথম হুলুস্থুল শুরু করে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। বিচিত্র এক সম্মিলিত সুরেলা হুংকারে নজরুলকে নিয়ে তারা গোটা ইউরোপবাসীর ড্রয়িং রুমে লাফিয়ে পড়ে। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’-এর বাংলাদেশি ঈদ আগমনী সংগীতে।
ইংল্যান্ডের ঈদ হয়ে উঠেছে এক মহাপরাক্রমশালী ইসলামি পার্বণ। ঈদমেলা, ঈদ ধামাকা, ঈদবাজার, ঈদ মেহেদি, ঈদ ফ্যাশন, ঈদ রেসিপি ইত্যাদি নামের আয়োজন আর আহাজারিতেই জমে ওঠে ঈদ-আনন্দ।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সব প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে গিয়ে ব্রিটেন একসময় যে উদারনীতি গ্রহণ করেছিল, এ তারই ফল। এখন এ দেশেই স্কুল ইউনিফর্মে ইসলামি উর্দি থেকে শুরু করে হালাল খাবার ও হিজাবের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ-মাদ্রাসা এবং নারীদের আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার দাবিও উঠছে। এসব উৎসবের দিনগুলোয় কোনো কোনো অঞ্চলকে চেনাই যায় না যে এ-ই বিলেত! ঈদের আগের রাতে লন্ডনের গ্রিন স্ট্রিট, ইলফোর্ড লেইন, হোয়াইট চ্যাপেল রূপান্তরিত হয় ছোট ছোট ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে। শুধু এর বিস্তার নয়, সেই সঙ্গে বিলেতেও জন্ম নিয়েছে ইসলামি সন্ত্রাসী। বিলেতি-বাংলাদেশি নারীরা এমনকি সন্তান সঙ্গে নিয়ে এ দেশ থেকে পালিয়ে ‘ধর্মযুদ্ধে’র জন্য চলে যাচ্ছে সিরিয়ায়। অভিবাসী কানুন ক্রমেই কড়া করেও হালে পানি নেই হোম অফিসের।
এক চান্দ্ররজনীতেই বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট রেমিট্যান্সের সব চলে যায় বাংলাদেশি ছাড়া আর অন্যান্য দেশের পাতে। পাগল হয়ে পুরুষ-নারীরা কেনেন বিলেতে আমদানি করা চুমকি জরি লাগানো সিনথেটিক পাকিস্তানি পায়জামা কুর্তা, ভারতীয় শাড়ি ও সালোয়ার, আরবি আলখেল্লা আর ফিলিস্তিনি প্যাটার্নের স্কার্ফ। তাঁরা কেনেন না বাংলাদেশি সুতি কিংবা শাল। কেনেন না টাঙ্গাইলের তাঁত বা মিরপুরের বেনারসি বা ঢাকাই জামদানি। সহজে তা পাওয়াও যায় না। রাত এক-দেড়টা পর্যন্ত গাড়ির হর্ন, এলোপাতাড়ি আড্ডা,

>এ দেশে ঈদ-বাণিজ্য মৌসুমে এখন মূলধারার বিপণিকেন্দ্রও মনোহর হয়ে ওঠে এথনিক সাজে। বিলেতে বসবাসকারী অনাবাসী মানুষের সব সাধ পূর্ণ করতে এরা এমন ব্যবসা করেন যে এ হয়ে উঠেছে এ দেশের ক্রিসমাসের মতোই আরেকটা ব্যবসা মৌসুম

পথে পথে মেহেদি, ঠান্ডা শরবত আর কুলফির সঙ্গে আসে ভিনদেশি ঈদ-বাণিজ্যের এক মহা সুযোগও। বিভিন্ন দেশ থেকে আসে খোরমা, খেজুর, বাদাম, পেস্তা, সেমাই, মাংস, পান-সুপারি, মেহেদি, মিষ্টি, শাড়ি, সালোয়ার, পাঞ্জাবি ও পোশাক। ভোক্তার সিংহভাগই কিন্তু আমাদের দেশের! কাজেই সারা বছর শাক-শুঁটকি খেয়ে বিদেশের ঈদ-বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ফেলে দিই দূরে।
অথচ কেবল বিলেতেই আছেন সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ। আর তার সবাই এই ঈদে কিনছে একই রকমের পোশাক পরিচ্ছদ। সবাইকে লাগে যেন এক পরিবারের বা এক দেশেরই জ্ঞাতি। এদের বচন শোনা না গেলে এরা যে বাংলাদেশি, তা-ও বোঝার উপায় নেই। পুরো ইউরোপেও অনুরূপ পরিস্থিতি। বাংলাদেশি সব টেলিভিশনে ওই সব পণ্যেরই বিজ্ঞাপন আর তার বিস্তার। দু-একজন সেলিব্রিটি ছাড়া কেউ পরেন না দেশি পোশাক। তাই ঈদ এলে আমার ক্রন্দন আসে। মনে পড়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রা দেশি ফ্যাশনের পক্ষে যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তিন দশক আগে আমাদের দেশে দেশি ফ্যাশনের চল শুরুতে তা ভূমিকা রেখেছিল। সাপ্তাহিক বিচিত্রার শাহাদত চৌধুরীকে কান্ডারি করে, গোটা বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে যে দেশি বস্ত্রের বান ডেকেছিল—আজ তার হাড়ে হাড়ে কেবল হাহাকার শুনি।
আগে এখানে আড়ং ছিল, এখন নেই। নিবু নিবু করে জ্বলছে নগরদোলা আর মিতালি। যাঁরা স্বকীয়তা বজায় রাখতে চান, তাঁরা দেশ থেকে পোশাক আনিয়ে নেন অথবা ওই কটি দোকানেই ভিড় করেন। স্ট্রিট মার্কেটে বাংলাদেশি পোশাক বিক্রেতাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, ‘আপা, আমাদের দেশি শাড়ির কম দাম। মানুষের ঈদ বাজেট অনেক বিরাট।’ তো?—এত কম দামে তারা ঈদ করবে না। এটা একটা কথা হলো?
এ দেশে ঈদ-বাণিজ্য মৌসুমে এখন মূলধারার বিপণিকেন্দ্রও মনোহর হয়ে ওঠে এথনিক সাজে। বিলেতে বসবাসকারী অনাবাসী মানুষের সব সাধ পূর্ণ করতে এরা এমন ব্যবসা করেন যে এ হয়ে উঠেছে এ দেশের ক্রিসমাসের মতোই আরেকটা ব্যবসা মৌসুম। এখন খাঁটি ব্রিটিশ সুপার মার্কেটগুলোর ‘এশিয়ান’ র্যাকগুলোও ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি পণ্যে। সেখানেও আমরাই মূল খদ্দের হলেও মূল বাণিজ্য হচ্ছে অন্যদের। অথচ কাঁঠাল থেকে শুরু করে কইতর, শাক-শুঁটকিসহ তিব্বত স্নো, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি—সবই কিন্তু আসছে। এসবের ক্রেতা মূলত বাংলাদেশিরাই। হতাশা, পরিবর্তনটা এল না পোশাকের ক্ষেত্রে ও বড় বাজেটে!
বিদেশে দেশি পোশাক প্রচলনের মহান ভূমিকাটা এখানের দেশি ফ্যাশন হাউস, টিভি, সংবাদপত্রগুলো এবং ব্যবসায়ী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সবাই মিলে কিন্তু করতে পারেন। আমরা যেভাবে সবাই একযোগে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করেছি, এখানেও তা করার সুযোগ আছে। নাহলে আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি চলে যাবে আমাদের আঙিনা দিয়া! আর আমরা তুলব তারই সেলফি!
ল­­ন্ডন
শামীম আজাদ: কবি, কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ।
lekhok@gmail. com