বিলেতের ক্রান্তিকালে জেরেমি করবিন

জেরেমি করবিন
জেরেমি করবিন

বোমাতঙ্ক নিয়েই এগিয়ে এসেছে বিলেতের সাধারণ নির্বাচন। আট জুন, ২০১৭ ব্রিটেনের রাজনৈতিক পালাবাদলের আরেক মুহূর্ত। গত প্রতিদিনই প্রার্থীদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তা ঘিরে জনপ্রিয়তার নিক্তি ওঠা-নামা করছে। প্রার্থীরাও বিভিন্ন ফোরামে দলীয় আক্রমণ করে চলেছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো সেখান থেকে রসদ নিয়ে খবর-ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে ছুড়ে দিচ্ছে—যেন ফ্রেশলি কুক্ড ফুড। সর্বশেষ জরিপে, গত ৬ জুন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন টোরি দল এগিয়ে ছিল মাত্র ৪ পয়েন্ট। অনেক পেছন থেকে এগিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-কে ধরে ফেলেছন শ্রমিক দলের নেতা জেরেমি করবিন।

ম্যানচেস্টারের মিউজিক কনসার্টে জঙ্গি হামলার পর থেকে টাওয়ার ব্রিজ বরোরোডে সদ্য হয়ে যাওয়া জঙ্গি হামলা পর্যন্ত জনমত ওঠানামা করছে। জটিল বিষয়ের সরল ব্যাখ্যা দানরত রাজনীতিকেরা সমালোচিত হচ্ছেন। টোরি দল ব্রেক্সিটের জন্য গণভোট দিয়ে হাত কামড়ে কূল পাচ্ছে না। আর লেবার পার্টি ব্রেক্সিটের সময় নিজেরাই নেতৃত্বের কোন্দলে ব্যস্ত থেকে মূল বিষয় নিয়ে যথাযথ কাজ না করার জন্য সমানভাবেই হাত কামড়াচ্ছে। এদিকে বিলেতের আগামী দিনের নীতির প্রশ্নে ইউরোপ ও আমেরিকা হয়ে উঠেছে প্রধান দুই বাটখারা। ভবিষ্যৎ ইংল্যান্ডের জন্য দুটিরই পক্ষপাত দরকার। এখন ইউরোপ না আমেরিকা প্রশ্নে কোন দল কোনটা থেকে বখরা কেটে পাল্লায় তুলতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।
এদিকে ঘোরগ্রস্ত ট্রাম্প প্যারিস পরিবেশ চুক্তি থেকে নিজেকে, নিজের দেশকে এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকাকে এক থাবায় তুলে ফেলে তুরুপের আরেক তাস ছেড়েছেন। ট্রাম্প যা বলেছেন, তার অর্থ গোল্লায় যাক দুনিয়ার পরিবেশ তাতে আমার কী! কিন্তু ট্রাম্পের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঢি ঢি পড়ে গেছে। ধরিত্রী প্রশ্নে এত স্বার্থপর হলে চলে না। তাই সবাই জোরেশোরে এর প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু রক্ষণশীল দলনেতা থেরেসা মে করেছেন মিন মিন করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে কোনো হবু দেশপ্রধানের মুখে এমন নমনীয় সুর মানায় না। বিশ্বের ক্ষমতাধর সাত দেশের মধ্যে ইংল্যান্ড অন্যতম। এমতাবস্থায় বিলেতের এই ক্রান্তিকালে শ্রমিক দল নেতা জেরেমি করবিন উঠে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি যা আগামী বিশ্বের শান্তি, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির পক্ষে, পরিবেশের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, ট্রাম্পের সমালোচনা করছেন।
এখন থেরেসা মে অথবা লেবার পার্টির প্রার্থী জেরেমি করবিন—যিনিই জিতুন; নির্বাচনের পরপরই তাঁকে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বসতে হবে। ব্রেক্সিটের পক্ষের টোরি সমর্থকেরা প্রচারণায় বলে গেলেন, কেবল মেই কঠোরভাবে দর-কষাকষি করে বিলেতের থালায় ফলাহার নিয়ে আসতে পারবেন। এদিকে আমার দরজায় লেবার পার্টির পক্ষের এক প্রচারক বললেন ভিন্ন কথা। তিনি বললেন, ব্রেক্সিটের ফলে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবাইকে যেভাবে খেপিয়েছে টোরিরা, তারা কোনো ছাড় পাবে না—করবিনের কথাই তারা শুনবে ভালো। স্কটল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ এসএনপি দল ব্রেক্সিটের পরেই বিলেত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকটি গণভোটের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। টোরির কারণেই ইউরোপ এখন বিলেতের দোস্ত থেকে দুশমন হয়ে গেছে। গুলি তো আর ফিরে আসবে না। তাই এখন নতুন গুলি ভরার খোপ খুঁজতে থেরেসা মে আমেরিকাকে তোষামোদ করছেন। ব্যাপারটা হয়ে গেছে, শ্যাম রাখি না কুল রাখি?
এবার আসি বোমাবাজির গোড়ার কথা নিয়ে। সেই কোন অজানা সময় থেকেই ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন ইস্যুতে আমেরিকার সঙ্গে ব্রিটেনের মিতালি ভাব এ দেশে রাজনৈতিক ইসলামীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। আমরা নিজেরাই দেখছি, কীভাবে জঙ্গিরা এ দেশে জন্ম নিয়ে, এখানে বড় হয়ে এখন এ দেশের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী বোমাবাজ হয়ে গেছে। এসব বোমাবাজরা তাদের মৃত্যুর আগে ভিডিওতে বারবার বিলেতের পররাষ্ট্রনীতির কথা সুস্পষ্ট করে বলে গেলেও সরকার তাতে আমল না দিয়ে কঠোর হয়েছে। তাতে লাভ হয়নি, হবেও না। কারণকে কেন্দ্র করে কাজ না করলে ওপরের লক্ষণ সিলগালায় কাজ হবে না।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময়ও হয়েছে অনুরূপ। সে সময় বিলেতের লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বুশ ও ব্লেয়ারের যৌথ মাতলামিতে সারা বিশ্ব যে তছনছ হলো, তার জেরেই বিপুল উদ্যমে শুরু হয়েছে এই জঙ্গিবাদ। সেই থেকেই এ দেশের সাধারণ মানুষেরা তাকে ‘ব্লাডি ব্লেয়ার’ বলে ডাকে। মজার কথা হলো তখন পার্লামেন্টে তাঁকে সমর্থন করেছিল কিন্তু এই টোরি দলই। আসলে ইচ্ছে চরিতার্থ শুধু রাম-এ হয় না, লাগে তার দোসর সুগ্রীব।
এখন কে হবেন আমাদের নেতা? যে দেশে যেমন মানুষ, তেমন হবে তাদের নেতা। বাংলাদেশেও কি তাই হচ্ছে না? এখন আমার হাতে জেরেমি করবিনের একটি বিজনেস কার্ড। কার্ডটা উলটেপালটে দেখছি। লেখা রয়েছে মেম্বার অব পার্লামেন্ট ফর ইজলিংটন নর্থ এমপি। পাশে আমার কড়ে আঙুলের মাথার সমান তার একটি ছবিও। এতটুকু এই ছবির সঙ্গে অতীতের একটি ছবি মেলানোর চেষ্টা করলাম। এখন দাড়ি সব পাকা। দেখতে লাগে যেন এক সম্ভ্রান্ত শক্তপোক্ত একজন প্রৌঢ়। সত্যি কথাটি বলেন। বলেছেন, বিলেতের পররাষ্ট্র নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। নির্বাচনী প্রচারেও সাইকেল নিয়ে হাজির হন তিনি। ঠিক এভাবেই আমার সঙ্গে মঞ্চের নিচে ২০১০ সালে কথা বলেছিলেন। সমালোচনা করেছিলেন ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন নীতিমালার। আমরা সেদিন হাজার হাজার বাংলাদেশি কারি ইন্ডাস্ট্রিতে ব্রিটিশ শেফ ও কর্মচারী আনা বন্ধ করার জন্য ট্রাফেল্গার স্কয়ারে জড়ো হয়েছিলাম। জেরেমি ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এখনো আছেন।

শামীম আজাদ: লন্ডনপ্রবাসী কবি ও লেখক