বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে দক্ষিণ এশিয়া কতটা এগোল

গবেষকদের ভাষ্য, শিশুকালের অপুষ্টি থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (বিশ্ব ক্ষুধা সূচক) ২০২১ কান্ট্রি-র‍্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়েছে। আইরিশ সাহায্য সংস্থা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’এবং জার্মান সংস্থা ‘ওয়েলট হাঙ্গার হিলফে’ যৌথভাবে বহুল আলোচিত এই র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করছে প্রায় দেড় দশক ধরে। সেখানে স্থান লাভকারী দেশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২০ সালে ১০৭টি থেকে ২০২১ সালে দেশের সংখ্যা ৯টি বেড়ে ১১৬টি দেশে দাঁড়িয়েছে। এই র‌্যাঙ্কিং নির্ধারিত হয় তিনটি বিষয়ের চারটি পরিমাপকের ভিত্তিতে: অপুষ্টি, শিশুর ওজনের ঘাটতি, শিশুর উচ্চতার খর্বতা এবং পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু মৃত্যুহার। এসব পরিমাপকের মান নেওয়া হয় জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত উপাত্ত থেকে, যার ফলে সূচকটির স্কোর নিয়ে আপত্তির তেমন সুযোগ নেই।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর ‘হাঙ্গার ইনডেক্স র‍্যাঙ্কিং’ প্রকাশিত হয় না। এই দেশগুলোর মধ্যে ২০২১ সালে পাঁচের কম স্কোর নিয়ে এক নম্বরে রয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশ বেলারুশ, গণচীন, ব্রাজিল, কুয়েতসহ ১৮টি দেশ আর ৫০ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ১১৬ নম্বরে সোমালিয়া। ইয়েমেন ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের অবস্থাও খুবই খারাপ। সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, হাঙ্গার ইনডেক্স স্টারভেশন বা অনাহার সূচক নয়, এটি খাদ্যের পুষ্টিমান ও শিশুমৃত্যুর গতি-প্রকৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস।

২০২০ সালে ১০৭ দেশের মধ্যে ৭৫তম অবস্থানের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ দেশের মধ্যে ৭৬তম। এ বছর বাংলাদেশের ক্ষুধা সমস্যাকে ‘মডারেট’ (স্কোর ১৯ দশমিক ৯ বা কম) বলা হচ্ছে, গত বছর যা ছিল ‘সিরিয়াস’ স্কোর (২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯)। ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৮ দশমিক ৬, সেখান থেকে গত ৯ বছরে আমরা চারটি পরিমাপকের প্রতিটিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করে সার্বিক স্কোরকে ২০২১ সালে ১৯ দশমিকে ১-এ নিয়ে এসেছি। ক্যালরি গ্রহণের ঘাটতিতে থাকা জনগোষ্ঠীর অনুপাতকে আমরা ২০০০ সালের ১৫ দশমিক ৭ থেকে ২০২১ সালে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার সঙ্গে হাঙ্গার ইনডেক্সের সূচকের উন্নতি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কিন্তু ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান নির্ণীত হয়েছে ১০১তম, ২০২০ সালে ছিল ৯৪তম। কিন্তু এ বছর ভারতের অবস্থান সাত ধাপ অবনমিত হয়েছে বলা ঠিক হবে না, যদিও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর অপুষ্টি, চাইল্ড ওয়েস্টিং এবং চাইল্ড স্টান্টিংয়ের ক্ষেত্রে উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ভারতের হাঙ্গার ইনডেক্সের স্কোর ২৭ ‘সিরিয়াস’ রেঞ্জে রয়ে গেছে। ২০২১ সালে পাকিস্তানের অবস্থান ৯২, নেপালের ৭৬ ও মিয়ানমারের ৭১। বাংলাদেশের অবস্থান ২০২০ সালে ভারতের ১৯ ধাপ ওপরে এবং ২০২১ সালে ২৫ ধাপ ওপরে থাকার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অবস্থান নেপাল ও পাকিস্তানের তুলনায় ক্রমাগতভাবে খারাপ নির্ণীত হতে থাকায় এই র‌্যাঙ্কিং স্বাভাবিকভাবেই ভারতে প্রচণ্ড বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। এ বছর গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের অবস্থান ৭১তম নির্ণীত হওয়ার পর এই বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে।

খাবারে আমিষ, মাইক্রো-নিউট্রেন্ট, ভিটামিন ও ফ্যাটের ঘাটতি অনেক বেশি থাকায় অপুষ্টি, ওজনের ঘাটতি ও খর্বতার সমস্যা নিম্ন আয়ের জনগণের মধ্যে ব্যাপকতর হওয়াই স্বাভাবিক। শুধু ভাত ও আটা-ময়দার মতো কার্বোহাইড্রেট বেশি খেয়ে মোটা হলেই এর সমাধান পাওয়া যাবে না। ভারত ও বাংলাদেশের শিশুর ক্যালরি গ্রহণ বেড়েই চলেছে, কিন্তু শিশুর ওজনের ঘাটতির স্কোরে ভারত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।

ভারত ইতিমধ্যে ২০২১ সালের এই র‍্যাঙ্কিং প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলে জিডিপি র‍্যাঙ্কিংয়ে এই দেশগুলো ভারতের অনেক নিচে অবস্থান করছে। সাধারণভাবেও মনে করা হয়, ভারতের জনগণের গড় জীবনযাত্রার মান পাকিস্তান ও নেপাল এমনকি বাংলাদেশের চেয়েও ভালো। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ইনডেক্স নির্মাণের ‘মেথডলজি’ ত্রুটিপূর্ণ কি না। কিন্তু বিষয়টির গভীরে গেলে পরিমাপকগুলোকে অতটা ত্রুটিপূর্ণ মনে হবে না। ভারতের জনগণের মধ্যে আয়বৈষম্য সমস্যা ক্রমবর্ধমান, রাজ্যগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বাড়ছে। বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সাধারণ জীবনমান এখনো দারিদ্র্যপীড়িত রয়ে গেছে। নিম্ন আয়ের ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মান গত কয়েক বছর বাড়ছেই না। খাবারে আমিষ, মাইক্রো-নিউট্রেন্ট, ভিটামিন ও ফ্যাটের ঘাটতি অনেক বেশি থাকায় অপুষ্টি, ওজনের ঘাটতি ও খর্বতার সমস্যা নিম্ন আয়ের জনগণের মধ্যে ব্যাপকতর হওয়াই স্বাভাবিক। শুধু ভাত ও আটা-ময়দার মতো কার্বোহাইড্রেট বেশি খেয়ে মোটা হলেই এর সমাধান পাওয়া যাবে না। ভারত ও বাংলাদেশের শিশুর ক্যালরি গ্রহণ বেড়েই চলেছে, কিন্তু শিশুর ওজনের ঘাটতির স্কোরে ভারত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারতের জনগণের গড় দৈহিক উচ্চতাও ক্রমেই কমে যাচ্ছে শিশুদের ওজনের ঘাটতি ও খর্বতার ব্যাপকতার কারণে।

এটা অনস্বীকার্য, মাথাপিছু জিডিপির কান্ট্রি-র‍্যাঙ্কিং সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের কঠিন সংগ্রামকে ঠিকমতো তুলে ধরতে পারে না। জনগণের আয়বৈষম্য বাড়তে থাকলে তার সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক অভিঘাত এসে পড়ে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জীবন ও জীবিকায়। আরও মারাত্মক হলো করোনাভাইরাস মহামারির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে দরিদ্রতম গোষ্ঠী। অথচ এ দুই বছরে মোদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আদানি ও আম্বানিদের মতো বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ বেড়েছে চার গুণের বেশি। মোদির শাসনামলে মুকেশ আম্বানির সম্পদ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সমালোচকদের একাংশের মতে, সরকারি নীতিমালার কারণেও ভারতের হাঙ্গার ইনডেক্সের ক্রমাবনতি ঘটতে পারে। সরকার জনগণকে প্রাণিজ আমিষ খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য যেভাবে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, সেটাকে গবেষকেরা ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

যাহোক, সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুষ্টিমানের গ্রহণযোগ্য প্রতিফলন গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের চারটি পরিমাপকে পাওয়া যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেপালের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের প্রায় অর্ধেক। এরপরও নেপালে বামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সূচকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেশটির সরকারের গণমুখী চরিত্রকেই সামনে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম। এরপরও তাদের গড় ক্যালরি ইনটেক ভারতের সমতুল্য হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ পাকিস্তানিদের ডায়েটে প্রাণিজ আমিষের প্রাধান্য দেশটির স্কোর ভারতের চেয়ে ভালো হওয়ার পেছনে হয়তো অবদান রাখছে! এটিও উল্লেখযোগ্য যে অপুষ্টি, শিশুর ওজন ঘাটতি ও খর্বতার ক্ষেত্রে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান সাব-সাহারান আফ্রিকার বুভুক্ষু দেশগুলোর মতোই খারাপ। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় শিশুমৃত্যুর হার প্রশংসনীয়ভাবে কমতে থাকায় এসব দেশের স্কোর সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়ে ভালো। ওপরের আলোচনা থেকে শিক্ষণীয় হলো, অনাহার সমস্যার সমাধানে দক্ষিণ এশিয়া অনেকটা সফল হলেও অপুষ্টি, শিশুর ওজনে ঘাটতি ও খর্বতার সমস্যা সমাধানে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে।

মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়