বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস: প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকার ও পছন্দই মূল কথা

১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জনসংখ্যা ইস্যুতে সচেতনতা বাড়ানো এবং এ-সংক্রান্ত পরিবেশ ও উন্নয়নের সম্পর্ককে লক্ষ্য রেখে এ দিবসটি ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ ও সদস্যদেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্‌যাপন করে আসছে। তবে ২০২১ সালের এ দিবস করোনাকালীন ২০২০ সালের ন্যায় হলেও অতীতের অন্যান্য সময়ের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় পরিবেশে পালন করতে হচ্ছে। গত প্রায় দেড় বছরে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস সমগ্র বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রার সব পর্যায়েই ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। জনমিতিক প্রক্রিয়া-জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তরও এর বাইরে নয়।

এ প্রক্রিয়ায় জন্মহার কিংবা সমগ্র প্রজনন হারকে প্রভাবিত করছে স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সংখ্যা ও মাত্রায়—প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকারের প্রয়োগের পরিসরে। ফলে স্থানভেদে কোভিডের এ সময়ে কোথাও প্রজনন হার বেড়ে যাচ্ছে আবার কোথাও-বা কমে যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় চলমান কোভিড-১৯ মহামারি বৈশ্বিক ও স্থানীয় উভয় পর্যায়েই স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বল দিক উন্মুক্ত করেছে। একই সঙ্গে নারী ও কিশোরীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফলে স্থানভেদে প্রজনন হারে প্রভাব পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাস্থ্য, অধিকার ও পছন্দ কোনোক্রমেই বাধাগ্রস্ত হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।

আমরা এখনো স্পষ্টভাবে জানি না কোভিড-১৯ মহামারির ফলে প্রজনন হারে কী প্রভাব পড়ছে বা পড়বে—তবে এটি ঠিক যে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবায় অগ্রাধিকার প্রয়োজন। আমরা জানি, ১৯৯৪ সালে মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন (আইসিপিডি) যে জনসংখ্যা নীতির আলোচনায় প্যারাডাইম শিফট ঘটে যেখানে জনসংখ্যার পরিমাণগত দিকের চেয়ে গুণগত দিকেই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির পছন্দ ও অধিকারই মুখ্য।

আর টেকসই বা বজায়যোগ্য উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০১৯ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আইসিপিডি) ২৫ বছর পূর্তিতে প্রদানকৃত পুনঃ প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন ও ২০৩০ সালের মধ্যে তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা (প্রথমটি শূন্য মাতৃ মৃত্যুহারে নিয়ে যাওয়া, দ্বিতীয় পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা শূন্যে নিয়ে আসা এবং তৃতীয়ত যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন দূরীকরণ ও বাল্যবিবাহ শূন্যে নিয়ে আসা) চলমান মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য চাহিদা মেটাতে ও সুরক্ষাহীনতাকে মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার, যেখানে অধিকার সুরক্ষা ও পছন্দের চর্চার মধ্য দিয়ে সমাধান খোঁজা সম্ভব।

এ প্রেক্ষাপটে এ বছর (২০২১) বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো‘অধিকার ও পছন্দই মূল কথা প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্ক্ষিত জন্মহারে সমাধান মেলে’। লক্ষণীয়, কোভিড-১৯ জন্মহারে কী প্রভাব রেখেছে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বিশেষ করে গুণগত উপাত্তের অনুপস্থিতিতে। তবে জনমিতিক পরিবর্তন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভিন্ন। অতীতে ঘটে যাওয়া সংকটজনিত ঘটনার বিশ্লেষণে লক্ষ করা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রজনন হার মহামারি বা সংকটকালে কমে গেছে (যেমন: কিছু ইউরোপিয়ান দেশ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও) এবং সংকট-উত্তর পরবর্তী সময়ে প্রজনন হার আবার বেড়ে তা পুনরুদ্ধারও হয়েছে। ফলে বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষেত্রেও সামনের মাস বা বছরে এমনটি ঘটতে পারে।

অধিকন্তু, বৈশ্বিক জনমিতিক পরিবর্তন অপরিবর্তনীয় থাকলেও একটি দেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান থাকতে পারে। পপুলেশন মমেন্টাম প্রভাবে সমগ্র প্রজনন হার হ্রাস পেলেও বাড়ন্ত যুব জনগোষ্ঠী প্রজননকাল বয়সসীমায় প্রবেশের কারণে। জাতিসংঘ সব মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারে অগ্রাধিকারে তাগিদ দিয়েছে। ইউএনএফপিএ তথ্য সূত্রে জানা যায়, মহামারি করোনা-পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কেবল ৫৫ শতাংশ নারী তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার এবং পার্টনারের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে অংশ নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমর্থ ছিল। মহামারিকালে সেবা প্রাপ্তি ব্যাহত হওয়া, চলাচলে বাধাসহ অন্যান্য কারণে নারীরা তাঁদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার চর্চা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। এসব বাধা জন্মহারে কি প্রভাব রেখেছে? কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের অনুপস্থিতিতে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ঘটেছে। ফলে এ সংকটকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে।

মহামারির কারণে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার, মাতৃস্বাস্থ্য, কাঙ্ক্ষিত পরিবারের আকার নির্ধারণে সক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে কি না, তা অনুসন্ধান করা এবং আদর্শ পরিবার গঠনে নারীর ক্ষমতায়নে নারীদের ও পলিসি নির্ধারকদের ভাবনা ও মতামতকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

নারীদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হলে প্রজনন স্বাস্থ্যে তাঁদের পছন্দ এবং অধিকার নিশ্চিত হবে। লক্ষণীয়, নিম্ন প্রজনন হার সংবলিত দেশগুলোতে সহজে জন্মহার বাড়ানো যাচ্ছে না। কোনো কোনো দেশে আর্থিক প্রণোদনা বা সহযোগিতা দিয়েও জন্মহার বাড়াতে পারেনি এবং এটি কোনো টেকসই সমাধানও নয়। এ ক্ষেত্রে জনমিতিক পরিবর্তন কী কী সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে—যেমন: পরিবারে পারস্পরিক সহযোগিতা, শিশু যত্ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, উচ্চ মাত্রায় জেন্ডার সমতা বজায় রাখা—সেদিকে লক্ষ রেখে সামগ্রিক পরিসরে ভাবা ও কাজ করা।

আমাদের দেশের প্রজনন হারে কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিয়ে গবেষণার দরকার। মহামারির কারণে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার, মাতৃস্বাস্থ্য, কাঙ্ক্ষিত পরিবারের আকার নির্ধারণে সক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে কি না, তা অনুসন্ধান করা এবং আদর্শ পরিবার গঠনে নারীর ক্ষমতায়নে নারীদের ও পলিসি নির্ধারকদের ভাবনা ও মতামতকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ইতিমধ্যেই গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারি কোভিড প্রাদুর্ভাবের সময়ে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বাধার সম্মুখীন হয়েছে।

দেশব্যাপী লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপে ও তা বাস্তবায়নে ঘাটতি, করোনাসংক্রান্ত সংক্রমণে প্রাথমিক পর্যায়ে ভীতি, পর্যাপ্ত জনবল-সংকট এবং সেবা প্রদানকারী এবং সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্ভূত বিরূপ পরিস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এ অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সেবা ব্যাহত হলে, প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা নিশ্চিত করা না গেলে, সঠিক সময়ে শিশুদের টিকা প্রদান করা না গেলে জন্মহার, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগ রয়েছে।

এ ছাড়া করোনার এ সময়ে বাল্যবিবাহ ও গৃহে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা লক্ষ করা গেছে বিভিন্ন গবেষণায়। তা ছাড়া নারীরা যাঁরা অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এখন অধিকতর দারিদ্র্য ঝুঁকিতে। ফলে বিদ্যমান বাস্তবতায় কোভিডকালীন ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাল্যবিবাহ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, কিশোরী মাতৃত্ব, উচ্চ মাতৃমৃত্যু হার, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা, পরিবারে সহিংসতার শিকার হওয়া, শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণ এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার মতো বিষয়গুলো।

তবে করোনার ভ্যাকসিন সব পর্যায়ে সরবরাহ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত কোভিডের এ সময়ে অধিকতর সুরক্ষাহীন নারী ও কিশোরীদের প্রথমেই স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকার নিশ্চিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এ সংকটকালে দরকার ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রাখা, একই সঙ্গে সেবার সঠিক মূল্যায়ন ও কার্যকর সেবা প্রদান বা সেবা গ্রহণে সার্ভিস প্রদান কার্যক্রমকে পর্যালোচনা করা, নতুন চাহিদার পরিসরে সুরক্ষা বা নিরাপত্তা প্রদান করা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খুঁজে বের করা ও বহুমুখী সেক্টর পরিকল্পনা করে অগ্রসর হওয়া। নীতিনির্ধারকদের এসব বিষয়ে কোভিডকালীন উপাত্তের শূন্যতা পূরণে কাজ করতে হবে। জন্ম-মৃত্যুর সঠিক ও সময়মতো উপাত্তের ভিত্তিতে পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে সব ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ই-মেইল: [email protected]