বিশ্ব বাঁচাতে যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপনা দরকার

আমরা সম্ভবত কোভিড-১৯ মহামারি এবং মহামারিজনিত অগণিত সংকটের অবসানের দিকে যাওয়া শুরু করেছি। এটি বিরাট সুখকর সম্ভাবনা। কিন্তু এর মধ্যেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা থেকে শুরু করে সামাজিক সংহতির সূচকে ধস নামার মতো নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সুনামি ধেয়ে আসছে।

আজ বহু মানুষ তাদের নেতাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জলবায়ুর মতো অনেক ইস্যুতে পর্বতপ্রমাণ ঝুঁকি এবং সেগুলো মোকাবিলার ক্ষেত্রে সামগ্রিক ব্যর্থতার মুখে পড়ে আমরা এখন দায়ী লোকদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। অনেকে অযোগ্য রাজনৈতিক নেতাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। কেউ কেউ ‘দাভোস ম্যান’ (সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলন হয়ে থাকে। সেখানে যোগ দেওয়া বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবেরদের ‘দাভোস ম্যান’ বলে কেউ কেউ উল্লেখ করে থাকেন) হিসেবে পরিচিত সিইওদের দোষ দিচ্ছেন। এর বাইরে একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংখ্যালঘু শ্রেণি ধ্বংসাত্মক ও গ্লানিকর পরিস্থিতির পেছনে অভিজাত শ্রেণির ষড়যন্ত্র দেখে থাকে।

কিন্তু আসল সত্য আরও জটিল। বৈশ্বিক ঝুঁকির পূর্বাভাস পাওয়া এবং তা ঠিকমতো সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার কারণ শুধু জলবায়ু পরিবর্তন ও সামাজিক বিভক্তি নয়। সংক্রামক রোগের পুনরুত্থান, ঋণের সংকট এবং অপর্যাপ্ত প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ বৈশ্বিক প্রশাসনব্যবস্থার একটি অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। আসলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সেগুলোর নেতৃত্ব আর আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টি গভর্ন্যান্স ওয়ান পয়েন্ট জিরো পিরিয়ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওই আমলে সরকারি এবং করপোরেট উভয় প্রশাসনব্যবস্থাই ‘এক ব্যক্তির’ শাসন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল। নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত ‘শক্তিশালী নেতা’ এবং ‘বস’রাই ছিলেন সেই ‘একক ব্যক্তি’।

এই ধরনের নেতৃত্বের অধীনে পদমর্যাদাভিত্তিক ক্ষমতাচর্চা হতো এবং সে ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক মসৃণভাবে কাজ করেছিল। সে সময় প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রায় প্রত্যেককে উপকৃত করেছিল।

১৯৬০–এর দশকের শেষের দিকে দ্য গভর্ন্যান্স টু পয়েন্ট জিরো মডেলের প্রশাসনব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই মডেলের ব্যবস্থা বস্তুগত সম্পদের প্রাধান্যকে নিশ্চিত করেছিল। এর সঙ্গে অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যানের ‘শেয়ারহোল্ডার ক্যাপিটালিজম’ এবং প্রগতিশীল বিশ্ব আর্থিককরণের উত্থানের সঙ্গে মিলে যায়। এই মডেলের প্রশাসনব্যবস্থায় শুধু ক্ষমতার ভাগীদারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকা নতুন ব্যবস্থাপক শ্রেণি সর্বোচ্চ মাত্রার রাজত্ব করেছিল এবং তাদের নাগাল ছিল বিশ্বব্যাপী।

২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট টু পয়েন্ট জিরো মডেলের বৈশ্বিক প্রশাসনব্যবস্থাকে গুরুতর ধাক্কা দেয়। এরপরও কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগপর্যন্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপকেরা আগের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রেখেছিলেন।

কোভিড-১৯–এর নৃশংস সামাজিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাত গভর্ন্যান্স থ্রি পয়েন্ট জিরো মডেলের প্রশাসনব্যবস্থার সূচনা করেছে। এই ব্যবস্থায় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বা আপৎকালীন সংকট ব্যবস্থাপনা বর্তমানে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এখন নেতারা অপারেশনাল চিন্তাভাবনার দিকে বেশি মনোনিবেশ করেন এবং সম্ভাব্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির বিষয়ে উদাসীনতা দেখান। এই স্বল্পমেয়াদি, ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরর পদ্ধতি অনুসরণের কারণে মহামারি সামাল দিতে গিয়ে সব ব্যবস্থাপনায় জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু যখন এই মহামারি শেষ হবে, তখন আমাদের একটি নতুন শাসন মডেলের প্রয়োজন হবে। গভর্ন্যান্স ফোর পয়েন্ট জিরো মডেলের সেই শাসনব্যবস্থাকে পূর্বসূরিদের শাসনব্যবস্থা থেকে বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে ভিন্ন হবে।

প্রথমত, নতুন মডেলকে চলমান স্বল্পমেয়াদি সংকট ব্যবস্থাপনার নীতি থেকে বেরিয়ে সে স্থলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চিন্তাভাবনা প্রতিস্থাপন করতে হবে।

সে ব্যবস্থায় মহামারি, আর্থসামাজিক সংকট এবং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বর্তমান সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করতে হবে। পাশাপাশি অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং মানব ক্রিয়াকলাপের কারণে পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গভর্ন্যান্স ফোর পয়েন্ট জিরো মডেলের প্রশাসনব্যবস্থাকে অবশ্যই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবখানে সমান গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

আমরা একটি অত্যন্ত জটিল এবং আন্তসংযুক্ত বিশ্বে বাস করি। ফলে একটি গোষ্ঠী বা একটি দেশ নীতি পরিবর্তন করলেই হবে না। সমাজের প্রতিটি অংশীজনের ভূমিকা এবং দায়িত্বে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।

তৃতীয়ত, অর্থনীতির সংকীর্ণ ধারণা এবং স্বল্পমেয়াদি আর্থিক স্বার্থের ওপর বর্তমানে যেভাবে জোর দেওয়া হয়ে থাকে, তা বন্ধ করতে হবে। এর জায়গায় সমাজ এবং প্রকৃতির প্রাধান্য যেকোনো নতুন শাসনব্যবস্থার মূলে আনতে হবে। অর্থ এবং ব্যবসা অত্যাবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেগুলো অবশ্যই সমাজ ও প্রকৃতির সেবার মধ্য দিয়ে করতে হবে।

এখনো অনেক নেতা গভর্ন্যান্স টু পয়েন্ট জিরো মডেলের শেয়ারহোল্ডার পুঁজিবাদের মানসিকতায় আটকে আছেন। আবার কিছু সমাজ এখনো শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং গভর্ন্যান্স ওয়ান পয়েন্ট জিরোর কাঠামোর পক্ষে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোভিড-১৯–এর হুমকি আছে, ততক্ষণ গভর্ন্যান্স থ্রি পয়েন্ট জিরো মডেলের আপাতত সংকট মোকাবিলার মানসিকতা বোর্ডরুম এবং মন্ত্রিসভা আলোচনায় আধিপত্য ধরে রাখবে।

আশার কথা, অনেক নেতা বৈশ্বিক প্রশাসনের নতুন যুগের অগ্রনায়কের ভূমিকা রাখছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতির নেতারা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। এর চেয়ে বড় কথা, তরুণ প্রজন্ম নিরাপদ ভবিষ্যতের দাবি তুলছে। তাদের সেই দাবি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপকদের পথনির্দেশনা দেবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • ক্লাউস শোয়াব ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান